এই শিল্পের কারিগরদের বলা হয় কুমার বা কুম্ভকার। কুম্ভকার বা কুমার একটি পেশা। কুম্ভকার শব্দটির অর্থই হলো কুম্ভ অর্থাৎ কলসি গড়ে যে শিল্পী। যে কর্মশালায় তারা এঁটেলমাটি, কাদামাটি বা চীনামাটির সাহায্যে হাঁড়ি-পাতিল ও বিভিন্ন আসবাব তৈরি করে, তাকে কুম্ভশালা বা কুমারশালা বলা হয়। কুমাররা যে পাড়ায় থাকে তাকে বলে কুমারপাড়া বা কুমারটুলি। কুমাররা গোলাকৃতির জিনিস বানানোর জন্য একটি ঘুরন্ত চাকা ব্যবহার করে। এটাকে চলতি কথায় ‘চাক’ বলে।
প্রাচীনকালে শুধু মাটির সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় পানি মিশিয়ে এবং অতিরিক্ত কোনো উপাদান ব্যবহার না করেই জিনিসপত্র তৈরি করা হতো। এক ধরনের নিখাদ কাদামাটিকে ছোট ছোট খণ্ড করে গোলাকার পাত্র বানানো হতো। অনেক সময় কাদামাটিকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক বস্তুতে রেখে আকৃতি প্রদান করা হতো। কুমারের চাকা তুলনামূলকভাবে অনেক পরের আবিষ্কার। আজকের দিনের কুমাররা প্রায় সবাই চাকা ব্যবহার করে থাকে। চাকের মাধ্যমে তারা মাটির পাত্রাদির প্রয়োজনীয় আকার দিয়ে থাকে।
অতীতে মৃৎশিল্প একচেটিয়াভাবে হিন্দুদের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। ঐতিহ্যগতভাবে বিষ্ণু হলেন কুমারদের প্রিয় দেবতা। মাটি দিয়ে নির্মিত গৃহস্থালির অসংখ্য তৈজসপত্রের মধ্যে রয়েছে কলসি, হাঁড়ি, জালা, সরাই বা ঢাকনা, শানকি, থালা, কাপ, বদনা, ধূপদানি প্রভৃতি। মাটি দিয়ে নির্মিত নানা রকম খেলনা ও ফল যেমন—তাল, কলা, কাঁঠাল বা আম ইত্যাদি আধুনিক মেলা বা উৎসবে জনপ্রিয় শিল্পপণ্য হয়ে উঠেছে। কুমারদের পেশা পারিবারিক ঐতিহ্যনির্ভর এবং নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে কাজ করে। বাংলাদেশে মৃৎশিল্প ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে চলছে। বিশ্বের প্রাচীন সব সভ্যতার নিদর্শনেই পোড়ামাটির তৈজসপত্র পাওয়া গেছে। আমাদের উপমহাদেশে সর্বপ্রথম মৃৎশিল্পের নিদর্শন পাওয়া যায় মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা সভ্যতায়। প্রাচীন শিলালিপি ও পুরাকীর্তিতে প্রাপ্ত বিভিন্ন নিদর্শন থেকে জানা যায়, এ দেশে উন্নত ও গুণগতমানের মৃৎশিল্প বর্তমান ছিল। কিন্তু সময়ের আবর্তনে অন্যান্য বস্তু যেমন— প্লাস্টিক বা ধাতু নির্মিত পণ্যের উদ্ভব ও ব্যবহার মৃৎশিল্পের ব্যাপক অবক্ষয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে গ্রামীণ এলাকায় শুধু দরিদ্ররা মাটির তৈরি সাদামাটা ধরনের সস্তা তৈজসপত্র ব্যবহার করে। শহরের ধনীরা তাদের ড্রয়িংরুম শোপিস ও গৃহের অভ্যন্তরীণ ডেকোরেশনে মাটির পণ্যাদি ব্যবহার করে থাকে।