ক্লান্তিতে হাল ছেড়ে দেওয়া আমার ভারি দুচোখ যখন মুদে আসতে থাকে গভীর ঘুমের আশায়, তারা ঠেলে ঠুলে তুলে দিতে চায় আমাকে। কেউ বুঝতে চায় না যে, বড্ড ক্লান্ত আমি। ক্লান্তির বোঝা টানতে টানতেই নিঃশেষিতপ্রায়। বিশাল বোঝার ভারে নিষ্পেষিত আমি। লড়াই করার আর কোন শক্তি অবশিষ্ট নেই আমার। লড়াই করতে চাইও না আমি। কেড়ে নেবার কোন অভ্যেস যে নেই আমার। প্রয়োজনটাই আসলে নেই।
কেউ ভাবে না, আসলে কি চাই আমি। আদৌ কিছু চাই কি না। কাঠিন্য দিয়ে মোড়ানো যে স্বেচ্ছামোড়ক রয়েছে চারপাশে আমার, তার ভিতরে আসলে ঘুণপোকারা বাসা বেঁধেছে দলবেঁধে। উপরের শক্ত আবরণটুকু সরালেই দগদগে সত্যের মত প্রকাশিত হয়ে যাবে ঝুরঝুরে নরম কাদামাটির ভাঙা বসতবাড়ি।
এত কিছু চাওয়া / না চাওয়ার মধ্যে একজনকেই চেয়েছি আমি। শুধু একজনকেই। আর কাউকেই নয়। তীব্রভাবে, মনের সমস্ত আকুতি দিয়ে, বুকের মধ্যে জমানো সবটুকু ভালবাসা দিয়ে চেয়েছি তাকে। বরষাভেজা এক স্বপ্নিল রাতে অচেনা অরণ্য পেরিয়ে সে এসেছিল করুণাধারায় সিক্ত করতে। স্বেচ্ছামৃত্যুর চোরাবালিতে গেঁথে যাওয়া একজনকে গভীর ভালবাসায় হাত ধরে টেনে তুলেছিল। মমতামাখানো কোমল হাতের স্পর্শে স্পন্দিত করেছিল আমাকে, পালটে দিয়েছিল আমার পুরোনো পৃথিবীকে। বিপুল বিস্ময়ে পুরো চোখ মেলে বদলে যাওয়া ভূবনকে দেখেছিলাম আমি তখন।
শুধুমাত্র তার কারণেই ঝুম বৃষ্টিতে মিলপুকুরের পাড়ে ভিজতে ইচ্ছে করে আমার। শুধুমাত্র তার কারণেই বিরান কোন বনের বনভাসানো নেশাময় বুনোগন্ধ নাকে নিয়ে তার হাতে হাত রেখে আঁকাবাঁকা সরু বুনোপথ ধরে হাঁটতে ইচ্ছে করে অনাদিকাল। চাঁদনী রাতে দূর সাগরের মাঝের নির্জন কোন দ্বীপের বিশাল কোন বৃক্ষের উপর করা গাছবাড়ির বারান্দায় পা ছড়িয়ে দিয়ে বসে গল্প শুনতে ইচ্ছে করে ভোর অবধি। জোছনাগুলোকে হাতের মুঠোয় ধরে ফুল বানিয়ে গুঁজে দিতে ইচ্ছে করে তার রেশমের মত মখমলে চুলের মাঝে। মাতাল করা গন্ধ নিতে ইচ্ছে করে ওই চুলের ঘন অরণ্যে নাক ডুবিয়ে। সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া নীল জলের সুখস্পর্শধন্য রুপোলি বালুতে শুয়ে কোলের মধ্যে মাথা রেখে কোমর জড়িয়ে ধরে ঘুমঘুম চোখে কবিতা শুনতে ইচ্ছে করে।
বদলে দেওয়া আমার এই পৃথিবী যে শুধু তার কারণেই পাওয়া। সে না এলে এগুলোর কিছুই যে জানতাম না আমি। জীবন থেকে যেত অনাড়ম্বরহীন, অতৃপ্ত। স্বাদগন্ধবর্ণহীন শুকনো পাতার মতন । প্রকৃতির সমস্ত সৌন্দর্য থেকে যেত অনালোকিত, অনাবিষ্কৃত আর অনাস্বাদিত।
