ছোট্ট একটা শহরের প্রাথমিক স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর এক শিক্ষিকা, যাঁর অভ্যাস ছিল ক্লাস শুরু হওয়ার আগে রোজ "আই লাভ ইউ অল্" বলা l তবে তিনি জানতেন, তিনি সত্য বলছেন না l তিনি জানতেন ক্লাসের সবাইকে একরকম ভাবে ভালও বাসেন না l
ক্লাসের রাজু নামে একটা বাচ্চা যাকে তিনি মোটেও সহ্য করতে পারেন না l রাজু ময়লা জামাকাপড়ে স্কুলে আসে l তার চুলগুলো থাকে উষ্কো-খুষ্কো , জুতোর বকলস্ খোলা, শার্টের কলারে ময়লা দাগ ....ক্লাসে পড়া বোঝানোর সময়ও সে সব সময় অন্যমনস্ক থাকে l মিসের বকুনি খেয়ে সে চমকে ওঠে আর তাঁর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে l তার সেই শূন্য দৃষ্টি দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় যে সে শারীরিকভাবে ক্লাসে উপস্থিত থাকলেও তার মন পড়ে থাকে অন্য কোথাও । ধীরে ধীরে রাজুর প্রতি মিসের মনে ঘৃণার উদ্রেক হতে থাকে lফলতঃ ক্লাসে ঢুকেই রাজুকে মিসের সমালোচনার শিকার হতে হয় l সবরকম খারাপ কাজের উদাহরণ হিসেবে রাজুর নাম আসতে থাকে l বাচ্চারা তাকে দেখে আর খিলখিল করে হাসে, মিসও তাকে অপমান করে সন্তোষ লাভ করেন l রাজু যদিও এইসব কথার কোনও উত্তর দেয় না l মিসের তাকে একটা নিষ্প্রাণ পাথর বলে মনে হয় ; যার মধ্যে অনুভূতি নামে কোন জিনিস নেই l সমস্ত ধমক, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আর শাস্তির জবাবে সে শুধু নিজের ভাবনায় শূন্য দৃষ্টিতে মিসের দিকে তাকায় আর মাথা নীচু করে নেয় l এইভাবে সে মিসের অত্যন্ত বিরাগভাজন হয়ে ওঠে l
এইভাবে প্রথম সেমিস্টার শেষ হয়। রিপোর্ট বের হয়। দেখা যায় রাজু প্রতিটি বিষয়ে ভীষণ খারাপ রেজাল্ট করেছে। ক্ষিপ্ত মিস তার প্রগতি পত্রে (রেজাল্ট কার্ড)একরাশ নেগেটিভ কথা লিখে দিলেন l স্কুলের নিয়মানুসারে মা -বাবাকে দেখানোর আগে প্রগতি পত্র হেড মিস্ট্রেসের কাছে পাঠাতে হয় । তিনি রাজুর রিপোর্ট দেখে মিসকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন,
"মিস ! প্রগতি পত্রে কিছু তো প্রগতির কথা লেখা উচিত্ ! আপনি তো যা কিছু লিখেছেন তার থেকে রাজুর বাবা একদম নিরাশ হয়ে যাবেন l"
মিস বললেন,
"আমি মাফ চাইছি, কিন্তু রাজু এক অশিষ্ট আর নিষ্কর্মা বাচ্চা l আমার মনে হয়না আমি ওর উন্নতির সম্পর্কে কিছু লিখতে পারি !"
মিস ঘৃণার সাথে এই কথা বলে সেখান থেকে উঠে এলেন l
হেড মিস্ট্রেস তখন অদ্ভুত একটা কৌশলের আশ্রয় নিলেন । তিনি চাপরাশির হাত দিয়ে মিসের ডেস্কের ওপরে রাজুর আগের বছরের প্রগতি পত্র রাখিয়ে দিলেন l
পরের দিন যখন মিস ক্লাসে ঢুকলেন তখন সেই রিপোর্ট কার্ডের ওপরে নজর পড়তে, উল্টে দেখেন সেটা রাজুরই প্রগতি পত্র ! ভাবলেন আগের বছরও নিশ্চয়ই সে এইরকম আচরণ করেছে ! ভাবার সাথে সাথেই তৃতীয় শ্রেণীর রিপোর্টটা খুললেন l রিপোর্টের মন্তব্য পড়ে ওনার আর আশ্চর্যের সীমা রইলনা, রাজুর উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় রিপোর্ট কার্ডটি ভরা - তাতে লেখা আছে,
"রাজুর মতো বুদ্ধিমান বাচ্চা আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি l অতি সংবেদনশীল বাচ্চা এবং নিজের সহপাঠী আর শিক্ষকের প্রতি সম্মান এবং সহযোগিতা করে l"
অন্তিম সেমেস্টারেও রাজু প্রথম স্থান আধিকার করেছিল l অস্থিরভাবে মিস চতুর্থ শ্রেণীর রিপোর্ট খোলেন, সেখানে লেখা আছে
"রাজুর লেখাপড়ার ওপর তার মায়ের অসুখের গভীর প্রভাব পড়ছে, পড়াশোনার প্রতি অমনোযোগী হয়ে উঠছে l"
ক'দিন আগে রাজুর মা মারা গেছে আর সেই সঙ্গে নিভে গেছে রাজুর জীবনের যাবতীয় আশা ভরসা আর সুন্দর ভবিষ্যতের আলোও l তাকে বাঁচাতে হবে .....আরও দেরী হয়ে যাওয়ার আগে l মিসের মাথায় যেন অত্যন্ত ভারী একটা বোঝা চেপে বসে....কাঁপা হাতে তিনি রিপোর্ট কার্ডটা বন্ধ করেন l তার চোখজোড়া অশ্রুসজল হয়ে ওঠে ....টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ে l
পরের দিন মিস যখন ক্লাসে ঢুকলেন তাঁর নিজের চির অভ্যস্ত বাক্যের পুনরাবৃত্তি করলেন,
"আই লাভ ইউ অল্" l কিন্তু বুঝতে পারছিলেন আজও তিনি সত্যের অপলাপ করছেন l কারণ আজ রাজুর প্রতি যে স্নেহ তিনি হৃদয়ে অনুভব করছেন...তা' ক্লাসের অন্য বাচ্চাদের জন্য হওয়া সম্ভব নয় l পড়া বোঝানোর সময় রোজের দিনচর্যার মতো রাজুর দিকে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন আর রাজুও বরাবরের মতো মাথা নীচু করে নিলো l আজ মিস কিছুই বললেন না। রাজুকে উদ্দেশ্য করে সহপাঠীদের সম্মিলিত হাসির শব্দ মিসের বুকে সেল হয়ে বিদ্ধ হল । তিনি দেখলেন আজ রাজুর মাথা মুন্ডিত, কেশহীন । তিনি রাজুকে কাছে ডাকলেন এবং একটা প্রশ্নের উত্তর বলে দিয়ে সেটা তাকে আওড়াতে বললেন l
রাজু তিন-চারবার চেষ্টার পর অবশেষে বলতে পারলো l তার জবাব দেওয়ার সাথে সাথে মিস খুশি হয়ে শুধু নিজেই তালি দিলেন না, সেইসঙ্গে অন্য সব বাচ্চাদের দিয়েও দেওয়ালেন l এরপর থেকে এটা প্রতিদিনের দিনচর্যা হয়ে উঠল l প্রথমে মিস সব উত্তর নিজে থেকে দিতেন, তারপর সস্নেহে রাজুকে বলতে সেগুলো বলত বলতেন।ধীরে ধীরে রাজু তার নিকষ অন্ধকারের চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল।মিস নিয়ম করে সব ভালো কাজের উদাহরণে রাজুর নাম টেনে আনতে থাকলেন। ফলতঃ বিষণ্ণতার কবর ফুঁড়ে রাজু বেরিয়ে আসলো l তাই এখন আর মিসকে প্রশ্নের সাথে উত্তর বলে বলে দিতে হয় না l সে রোজ সঠিক উত্তর দিয়ে সবাইকে চমকিত করে এবং নতুন নতুন প্রশ্ন করে সকলকে হয়রানও করে।
তার চুলগুলো এখন অনেকটা পরিপাটি থাকে, জামাকাপড়ও যথেষ্ট পরিষ্কার । হয়তো সে এখন নিজেই তার জামাকাপড় কেচে নেয় । দেখতে দেখতে বছর শেষ হয়ে গেল, রাজু দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ হলো l
এদিকে মিসের জেনারেল ট্রান্সফারের অর্ডার চলে আসে। বিদায়কালীন সমারোহে সব বাচ্চারা মিসের জন্য সুন্দর সুন্দর উপহার নিয়ে আসে আর মিসের টেবিলের ওপর একের পর এক পাহাড় জমতে থাকে । এত সুন্দরভাবে প্যাক করা উপহারের মধ্যে পুরানো কাগজে অগোছালোভাবে মোড়া একটা উপহার মিসের চোখে পড়ে যায় । বাচ্চারা সেটা দেখে হাসতে থাকে l কারও জানতে বাকি ছিল না যে উপহার হিসেবে সেটা রাজুই এনেছে l মিস উপহারের এই ছোট পাহাড় থেকে সেটা বার করে আনলেন l খুলে দেখলেন তার ভিতরে মহিলাদের আতরের অর্ধেক ব্যবহার করা একটা শিশি আর এক হাতে পরার মতো বড় একটা বালা যার বেশিরভাগ মোতি ঝরে গিয়েছে l মিস চুপচাপ শিশি থেকে নিজের গায়ে আতর ছিটিয়ে দিলেন এবং বালাটা হাতে পরে নিলেন l বাচ্চারা এই দৃশ্য দেখে খুব অবাক হয়ে গেল l রাজু নিজেও l শেষ পর্যন্ত রাজু থাকতে না পেরে মিসের কাছে এসে তার গা ঘেঁষে দাড়াল।
কিছুক্ষণ পর সে থমকে থমকে মিসকে বলল, "আজ আপনার গা' থেকে আমার মায়ের মতো গন্ধ আসছে l " মিস তাকে বুকে টেনে নিলেন।
এরপর সময় পাখা মেলে উড়তে লাগলো l দিন সপ্তাহে, সপ্তাহ মাসে আর মাস বছরে বদলাতে থাকল। কিন্তু প্রত্যেক বছরের শেষে রাজুর কাছ থেকে একটা চিঠি নিয়মিতভাবে আসতো যাতে লেখা থাকতো, "এই বছর অনেক নতুন টিচারের সংস্পর্শে এসেছি কিন্তু আপনার মতো কেউ ছিলনা l" তারপর একসময় রাজুর স্কুলপর্ব শেষ হয় এবং শেষ হয় চিঠির ধরাবাহিকতাও l কয়েক বছর পর মিস তার কর্মজীবন থেকে অবসর নিলেন। হঠাৎ একদিন তাঁর নিজের মেলে রাজুর চিঠি পেলেন যাতে লেখা ছিলো,
"এই মাসের শেষে আমার বিয়ে, আপনাকে ছাড়া বিয়ের কথা ভাবতে পারিনা, আরেকটা কথা .....জীবনে আমি অনেক লোকের সাথে মিশেছি, কিন্তু আপনার মতো দেখিনি "...ডক্টর রাজু । সাথে প্লেনে যাওয়া আসার টিকিটও খামের মধ্যে ছিলো l মিস নিজেকে কিছুতেই আটকে রাখতে পারছিলেন না l তিনি স্বামীর থেকে অনুমতি নিয়ে রাজুর বিয়েতে যাওয়ার জন্য রওনা দিলেন l বিয়ের দিনে যখন বিয়ের আসরে উপস্থিত হলেন তখন খানিকটা দেরী হয়ে গেছিলো l তাঁর মনে হয়েছিল বিয়ের অনুষ্ঠান নিশ্চয়ই শেষ হয়ে গেছে.....কিন্তু এটা দেখে তাঁর আশ্চর্য হওয়ার সীমা ছিলনা ; শহরের বড় বড় ডাক্তার, বিজনেসম্যান, এমনকি বিয়ে দেবেন যিনি সেই পণ্ডিতজীও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন যে এখনও কার আসা বাকি আছে ....অনড় রাজু বিয়ের অনুষ্ঠানের মণ্ডপের বদলে গেটের দিকে চোখ লাগিয়ে কারও আসার অপেক্ষা বসে আছে । তারপর সবাই দেখল ছোটবেলার সেই টিচার গেটের ভিতরে ঢুকতেই রাজু তাঁর ওপর যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল । রাজু মিসের দু'হাত জড়িয়ে ধরল। মিসের হাতে সেই মরচে পড়া, মতি ঝরা বালাটা। রাজুর দু'চোখ জলে ভরে উঠল। সে মিসকে সসম্মানে মঞ্চে নিয়ে এলো l এরপর মাইক হাতে নিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলল,
"বন্ধুরা ! আপনারা সবাই সবসময় আমাকে আমার মায়ের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন আর আমি আপনাদের সবার কাছে প্রতিজ্ঞা করতাম যে খুব শিগগির আপনাদের সবাইকে তাঁর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো l l l ......ইনি আমার মা - ----------"
_______
!! প্রিয় ভাইবোনেরা ......এই সুন্দর কাহিনী শুধু শিক্ষক -ছাত্রের সম্পর্কের কথা ভাববেন না l নিজেদের আশেপাশে দেখুন, রাজুর মতো কোনও ফুল ম্রিয়মাণ থাকলে আপনার একটু মনোযোগ, ভালবাসা আর স্নেহ নতুন জীবন দিতে পারে .....
Solaiman Hasan Bappy
Delete Comment
Are you sure that you want to delete this comment ?
Md. Mashum Ali
জয়েন করলেই পাবেন 100টাকা। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এফিলিয়েট প্লাটফর্মে স্বাগতম। সহজ এফিলিয়েট গ্রোগ্রামে জয়েন করে আজীবন ইনকাম করতে পারবেন।
Delete Comment
Are you sure that you want to delete this comment ?