এক চিলতে রোদ


কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত নীতি এই বাড়ির কাজের মেয়ে ছিল। কিন্তু এখন? এখন এই বাড়ির একমাত্র ছেলে আহিয়ান চৌধুরী অভ্রের ব

.

 

সূচনা পর্ব

 

 কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত নীতি এই বাড়ির কাজের মেয়ে ছিল। কিন্তু এখন? এখন এই বাড়ির একমাত্র ছেলে আহিয়ান চৌধুরী অভ্রের বউ। এই বাড়িতে নীতির অবস্থানের পদোন্নতি হয়েছে। কাজের মেয়ে থেকে সোজা বাড়ির একমাত্র বউ হয়ে গেল।

বাসর ঘরে বধূ সেজে বসে থেকে কথা গুলো ভাবছে নীতি। গায়ে লাল বেনারসি জড়ানো আর অনেক গুলো ভারী ভারী গহনা। গলায় লাল পাথর বসানো যে হারটা,তা অভ্রের দাদীর। তিনি খুব যত্ন করে এই হারটা তার নাতবউয়ের জন্য তুলে রেখেছিলেন। বেনারসিটাও বেশ ভারী, নিশ্চয়ই বেনারসিটা অনেক দামী হবে। অবশ্য দামী হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। কেনার সময় তো আর কেউ এই কথাটা জানতো না, যে এতো দামী এই বেনারসি বাড়ির কাজের মেয়েটার গায়ে জড়াবে। দাদীও তো জানতো না উনার এতো আহ্লাদের যত্ন করে রাখা হারটা অবশেষে কাজের মেয়ের গলায় ঝুলবে। তার চোখে পানি টলমল করছে। আজ কী তার সুখের দিন নাকি কষ্টের দিন তা বুঝে উঠতে পারছে না। সবারই তো নিজের বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন থাকে। নীতিরও ছিল।

 

একদিকে নীতি এই ভেবে কষ্ট পাচ্ছে তার জন্য এই সংসারটা এলোমেলো হয়ে যেতে বসেছে। আবার পরক্ষণেই ভাবছে যা হয়েছে তা তো আল্লাহর ইচ্ছেতেই হয়েছে। আল্লাহ তার ভাগ্যে অভ্রকে লিখে রেখেছিল বলেই তো আজ অভ্রের সাথে ওর বিয়েটা হলো। কিন্তু নীতি তো চাইতো না তার বিয়েটা এভাবে হোক।

আমরা যা কিছুই চাই না কেন তা ততক্ষন হবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত আল্লাহ তা চাইবেন।

 

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

"আর তোমরা চাইলেই কিছু হয় না, যতক্ষণ না আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তা চান।"

(সূরা-তাকবিরঃ২৯)

"- আল্লাহর হুকুম ছাড়া তো কোনো কিছুই সম্ভব না। এই বিয়েটা আল্লাহর ইচ্ছেতে হয়েছে, তাই এই বিয়ে নিয়ে আমি মন খারাপ করতে পারি না। আমি এই বিয়ে হাসি মুখে মেনে নিবো।

নীতির বিশ্বাস আল্লাহ তার জন্য ভালো কিছু ভেবে রেখেছেন। আর এই বিয়েটাও উনার ইচ্ছাতেই হয়েছে।

 

আল্লাহ পাক বলেন,

" আমি যখন কোন কিছু করার ইচ্ছা করি; তখন তাকে কেবল এতটুকুই বলি যে,হয়ে যাও, সুতরাং তা হয়ে যায়।"

(সূরাঃ- নাহল -৪০)

 

হাজারো রজনীগন্ধা আর গোলাপে সাজানো এই ঘর টায় আগেও সে অনেক বার এসেছে। তবে কোনো দিনও ভাবতে পারেনি একদিন এই ঘর টায়, এই বিছানায় সে বউ সেজে বসে থাকবে তার স্বামীর অপেক্ষায়। স্বামী? হ্যাঁ স্বামী, আজ থেকে তো অভ্র তার স্বামীই।

জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যাকে সে বড় জেঠুর ছেলে হিসেবে জেনে এসেছে, কখনও সে সামনে পরলে মাথা নিচু করে নিয়েছে সে আজ তার স্বামী। নীতি তার তাকদীরের লেখা হাসি মুখে মেনে নিয়েছে। তাকদীরে যা লেখা আছে তা-ই হবে, তার বাইরে কিছু ঘটা সম্ভব না।

 

সহিহ মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে- তিনি বলেন,

"আমি রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি তিনি বলেন; আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিকূল

সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগে সৃষ্টিকূলের তাকদীর লিখে রেখেছেন।"

তিনি আরো বলেন,

" আল্লাহ তাআলা প্রথম সৃষ্টি করেছেন কলম। সৃষ্টির পর কলমকে বললেন, 'লিখ'। কলম বললো, ইয়া রব্ব! কি লিখব? তিনি বললেন, কেয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেক জিনিসের তাকদীর লিখ।"

(আবু দাউদ -৪৭০০)

 

"- ওই ছোট লোকের বাচ্চাটাকে আমি এই চৌধুরী বাড়ির বউ হিসেবে মানি না।

নীতি রুমে বসে কথা গুলো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। কথা গুলো বলছে বড় জেঠু, মানে যে আজ থেকে ওর শ্বশুর। নীতি চোখ মুছে নিলো। ছোট থেকে এসব শুনে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এসব তার জন্য নতুন কোন কথা না। তবুও আজ এই কথা গুলো শুনে নীতির ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা তার বাবা মা যদি বেঁচে থাকত তাহলে কি আজ তাকে এই পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতো?

 

"- আমি এক্ষুনি ওই ছোট লোকের বাচ্চাটাকে তোমার রুম থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে দিব।

এতদিন এই বাড়িতে থেকে এসব করেছে সে। বামুন হয়ে চাঁদ ধরার শখ হয়েছে তার। আজ আমি জন্মের জন্য তার সব শখ ঘুচে দিব।

জহির চৌধুরী সিংহের মত গর্জন করতে করতে অভ্রের রুমের দিকে যেতে নিলেন। অভ্র তার বাবার সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়াল। খুব শান্ত গলায় বললো,

"- বাবা তোমার সুবিধার্থে একটা কথা বলে রাখি নীতি কিন্তু কোনো ছোট লোকের বাচ্চা না।

জহির চৌধুরী চোখ মুখ শক্ত করে বললেন,

"- কি বলতে চাইছো তুমি?

"- আমি এখনও ঠিক তেমন কিছু বলতে চাচ্ছি না। তবে তুমি যদি আর একবারও নীতিকে ছোট লোকের বাচ্চা বা কাজের মেয়ে এই ধরনের কোনো কথা বলো। তাহলে কিন্তু আমি এমন কিছু কথা বলবো যা শোনার জন্য তুমি মোটেও প্রস্তুত নও ।

"- অভ্র!

"- আগে যা হয়েছে তা ভুলে যাও বাবা। নীতি এখন তোমার ছেলের বিয়ে করা বউ। এই চৌধুরী বাড়ির সম্মান। সব কিছু ভুলে গিয়ে আমাদের তুমি মেনে নাও।

"- আমি মরে গেলেও ওকে চৌধুরী বাড়ির বউ হিসেবে মেনে নিব না।

"- মেনে না নিলে তো কিছু করার নেই বাবা। তুমি না মানলেও নীতি আমার ওয়াইফ।

আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো ও যাতে এই বাড়িতে তার যোগ্য সম্মান টুকু পায়। কেউ আমার ওয়াইফকে ছোট করতে চাইলে আমি তাকে ছেড়ে কথা বলবো না বাবা। তাই বলে রাখছি তুমিও কিন্তু নীতিকে ছোট করতে চেও না তাহলে কিন্তু তোমার সাথেও খারাপ ব্যবহার করতে বাধ্য হব আমি।

তুমি যদি জেদ ধরে থাকো নীতিকে তুমি মেনে নিবে না, তাহলে আমিও কিন্তু তোমারই ছেলে। আমিও জেদ ধরতে জানি। আর তুমি এটাও জানো আমার জেদটা তোমার থেকে একটু বেশিই আছে।

জহির চৌধুরী নিজের ছেলের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

অভ্র খুব শান্ত ভাবে হেঁটে নিজের রুমের দিকে যেতে লাগলো।

জহির চৌধুরী চেয়ার ধরে ধপ করে বসে পড়লেন। অভ্র আজ উনার মুখে মুখে কথা বলেছে। এত বড় হয়ে গেছে অভ্র!এখন সে বাবার কথার পিঠে কথা বলতেও দ্বিধাবোধ করে না। এত সহজেই উনার চোখে চোখ রেখে উচু গলায় কথা বলেছে? এই দিন দেখার জন্যই কি ছেলেকে এতো কষ্ট করে বড় করেছেন? এই জন্যই কি ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে উচ্চ শিখায় শিক্ষিত করেছেন?

 

ফুলবানু এতক্ষণ নিজের রুমে বসে ছেলে আর নাতির কথা শুনছিলেন। এসব শুনেও তিনি বাইরে বের হননি। এই সংসারে এখন কেউ আর উনার কথা শুনে না। সবাই নিজেদের মত চলে। বৃদ্ধ মায়ের কথা এখন জহির চৌধুরী তেমন কানে নেয় না। ছেলের বউ এখনও উনাকে মেনে চলে তবে ফুলবানু এখন নিজেই সংসারের চিন্তা ছেড়ে দিয়েছেন। স্বামী নেই সংসারের ছেলেরা সবাই নিজেদের রাস্তা ধরে নিয়েছে, নিজেদের ভালো বুঝতে শিখে গেছে। এখন এই সংসার আগলে রেখে কী হবে আর?

 

ফুলবাবু পান চিবাতে চিবাতে নিজে নিজেই কথা বলছেন,

"- একদম ঠিক হইছে তোর লগে। তুই তো অহন আমার কথার দাম দেছ না। দেখ আল্লাহর লীলাখেলা তোর পোলাও তোর কথার দাম দেয় না।

অসহায় মাইয়াডা রে ছোট থেইকাই কষ্ট দিছস তুই। সব থাকতেও তারে বাড়ির কাজের লোক বানাইয়া রাখছস।

মাইয়াডা খাইতে বইতে চোখের পানি ফেলছে। আল্লাহ কি তোর বিচার করবো না? ঠিক করবো, এই তো শবে শুরু হইছে তোর শাস্তি। আল্লাহ কোনো দিন কারো প্রতি অন্যায় সহ্য করেন না।

ফুলবানু এখনও সেকেলের রয়ে গেছেন। বইয়ের লেখা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারেন না। গ্রামের মানুষ শহরে এসেও নিজের কথা বার্তায় পরিবর্তন আনতে পারেননি। বৃদ্ধ বয়সে বোধ শক্তিও লোভ পেয়েছে কিছুটা। মুখে যখন যা আসে তা-ই বলে ফেলেন। ছেলের সামনে দেখান উনি ছেলেকে অনেক ভয় পান।

"- আমার অভ্র ভাইডা জীবনে একটা ভালা কাম করছে। বাপের মত নাদান হয় নাই। মাইয়াডা রে বিয়া কইরা বাপের পাপ একটু হইলেও কমাইছে।

ওই নাদানডা জীবনে কোনো ভালা কাম করছিল যার লাইগা ওর ঘরে অভ্রের মত একটা পোলা জন্ম নিছে। 

-----------------------------------------------------------

অভ্র দরজা ঠেলে ভেতরে আসলো। রুমটা আধো আলো আধো অন্ধকার। রজনীগন্ধার গন্ধের সাথে যুক্ত হয়ে গোলাপের চাপা গন্ধ।

সব মিলিয়ে অন্য রকম একটা পরিবেশ।

অভ্র দরজা লাগিয়ে রুমের লাইট অন করে দিলো। এতক্ষণ শুধু রুমে মোমবাতির আলো ছিল। এখন ইলেক্ট্রিক বাল্বের আলোয় মোমবাতির অতি সরু আলো গুলো চাপা পড়ে গেছে।

অভ্র বেডের মাঝখান টার দিকে তাকিয়ে দেখে কতশত গোলাপ আর রজনীগন্ধার মাঝে একটা জীবন্ত ফুল বসে আছে। মাথায় এক হাত লম্বা ঘোমটা দিয়ে কাচুমাচু হয়ে বেডের এক কোণায় চুপটি মেরে বসে আছে। নীতিকে নিজের বেডে বৌয়ের সাজে বসে থাকতে দেখে অভ্র মনের মাঝে এক অজানা সুখ অনুভব করছে।

অভ্রকে রুমে আসতে দেখে নীতির কলিজার পানি শুকিয়ে গেছে। শাড়ির আঁচল আঙুলে পেঁচিয়ে ধরছে বারবার। অভ্র বেডের সামনে এসে দাঁড়ানোর সাথে সাথে নীতি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে সালাম দিলো।

"- আসসালামু আলাইকুম।

"- ওয়ালাইকুমুস সালাম।

অভ্র সালামের জবাব দিলো পরক্ষণেই দু'জনই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। আসলে বলার মত কোনো কিছুই ওরা ভেবে পাচ্ছিল না। পুরো রুমে থমথমে নীরবতা নেমে আসলো। অভ্র কী বলবে তা ভাবতে ভাবতে নীতি নিজে থেকেই বলে উঠলো,

"- দাদী বলেছিল আপনাকে পায়ে ধরে সালাম করতে। কিন্তু পায়ে হাত দিয়ে সালাম করার বিধান তো ইসলামে নেই তাই না। পা ছুঁয়ে সালাম করার সময় যদি ভুলবশত বা অনিচ্ছায় যেভাবেই হোক মাথা নত হয়ে যায় তাহলে তো আল্লাহর সাথে শিরক করা হবে। মুসলমানরা মাথা শুধুমাত্র আল্লাহর সামনেই নোয়াবে। অন্য কারো সামনে নয়।

পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা এটা ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে এসেছে। যা অনেক মুসলিমরাই অনুসরণ, অনুকরণ করছে। এ কাজ একেবারেই গর্হিত কাজ।

নবী (সাঃ) ও সাহাবারা তাঁদের বাবা মা'কে মুখে সালাম দিতেন পা ছুঁয়ে সালাম করতেন না। মুসলমানদের আদর্শ হচ্ছে নবী (সাঃ) ও সাহাবাদের আদর্শ। তারা আমাদের শিখিয়েছেন সালাম দিতে।

সুন্নত হচ্ছে, " আসসালামু আলাইকুম " বলে দুআ করা। সালামের শব্দ নির্দিষ্ট, এর মধ্যে বৃদ্ধি করাও জায়েজ নেই, নতুন করে তৈরি করাও জায়েজ নেই।

এখন নতুন বৌদের শ্বশুর শ্বাশুড়ি বা অনান্য মুরুব্বিদের সালাম করতে বলা হয়। কিন্তু এটা তো ঠিক না।

সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) বসে থাকা অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আসলে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান করা নিষিদ্ধ ছিল। আর সেখানে পা ছুঁয়ে সালাম করতে গেলে তো প্রায় মাথা নুইয়ে রুকু সিজদার মত হয়ে যায়।

হাদীসে আছে,

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) তিনি বলেন, কোন এক সময় জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করলো, "হে আল্লাহর রাসূল আমাদের কোন ব্যক্তি তার ভাই কিংবা বন্ধুর সাথে দেখা করলে সে কি তার সামনে ঝুঁকে (নত) যাবে? তিনি বললেন,না। সে আবার প্রশ্ন করলো, তাহলে কি সে গালাগালি তাকে চুমু খাবে?

তিনি বললেন, না। সে আবার বললো, তাহলে সে তার হাত ধরে মুসাফাহা (করমর্দন) করবে?

তিনি বললেন, হ্যাঁ।

(ইবনু মা-জাহ ৩৭০২ জামে আত -তিরমিযী, হাদীস নং- ২৭২৮)

 

অভ্র এতক্ষণ মুগ্ধ হয়ে নীতির কথা শুনছিল। এতো সুন্দর করে এতোটা গুছিয়ে কেউ কীভাবে কথা বলতে পারে? আর অভ্র এটা ভেবে অবাক হচ্ছিল, নীতির বলা অনেক কথাই অভ্র আগে জানতো না। নীতি এতো অল্প বয়সী একটা মেয়ে এতো কিছু জানলো কীভাবে?

নীতির চুড়ির ঝনঝন শব্দে অভ্রের ধ্যান ভাঙলো। অভ্র নিচু হয়ে মাথা চুলকিয়ে বললো,

"- হুম তা ঠিক। পায়ে ধরে সালাম করতে হবে না।

নীতি মনে মনে লজ্জা পেল। কী দরকার ছিল অভ্রের সামনে এতগুলো কথা বলার?

নীতি ঘোমটার নিচ থেকে চারিদিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। অভ্র তা খেয়াল করে বললো,

"- কিছু লাগবে?

"- হুম।

"- কি লাগবে আমাকে বলো।

"- এই রুমে কি পেন পেপার আছে?

"- হুম ঐ ড্রয়ারে আছে। কিন্তু কেন?

নীতি কোনো উত্তর দিল না। ড্রয়ার থেকে পেন পেপার বের করে দাঁড়িয়ে থেকে নীচু হয়ে ঝুঁকে কাগজে কিছু একটা লিখে ফিরে দাঁড়াল।

নীতি সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সময় মাথা থেকে এক হাত লম্বা ঘোমটা-টা পড়ে গেল। অভ্র মন্ত্রমুগ্ধের মত নীতির দিকে তাকিয়ে আছে। নীতিকে আজ এই প্রথম অভ্র ঘোমটা ছাড়া দেখলো। এর আগে তো নীতি সব সময় বাসায় মাথায় ওড়না দিয়ে রাখত। আর ভুলেও অভ্রের সামনে আসতো না। হঠাৎ হঠাৎ অভ্র ওর সামনে এসে গেলে মুখ পেছনে ফিরিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে যেত। কারো চেহারা যে এতটা ইনোসেন্ট হয় তা অভ্রের জানা ছিল না। ঘোমটার পেছনের এই মেয়েটা যে এতটা সুন্দর হবে তা অভ্র কল্পনাও করেনি।

অভ্র অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো কিছু বলতে পারলো না।

"- এই নিন।

"- কী এটা?

বলতে বলতে অভ্র কাগজ টায় চোখ বোলালো।

"- দাদী বলেছে এই দুআটা যেন আপনাকে কাগজে লিখে দিই। আপনি হয়তো না-ও জানতে পারেন। দাদী এখানে দিয়ে যাওয়ার আগে কড়া করে বলে দিয়ে গেছেন।

অভ্র হাসলো। বললো,

"- লিখে দেওয়ার দরকার ছিল না। দাদী আমাকে যতটা অপদার্থ ভাবে আমি কিন্তু ঠিক ততটাও অপদার্থ না। এই দুআটা আমি জানি।

নীতি আবারও লজ্জা পেয়ে গেল। জিবে কামড় দিয়ে মনে মনে বললো, (এই দাদীটা আমাকে এমন ভাবে লজ্জায় ফেলতে পারলো? উনি কি ভাববেন? আমাকে নিশ্চয়ই বাচাল ভাবছেন। ভাববেন আমি বেশি পাকনামি করি। ইয়া আল্লাহ!)

অভ্র মনে মনে বললো ("দাদী যে একে দিয়ে এখন আরো কী কী করাবে তা আল্লাহ জানে")

অভ্র এক গাল হেসে বললো,

"- আমি তোমার মত এতো কিছু না জানলেও কিছু কিছু বিষয়ে জানি। প্র্যাক্টিসিং মুসলিম না হলেও ইসলাম সম্পর্কে অনেকটা সচেতন।

অভ্র দু'পা এগিয়ে গিয়ে নীতির কপালের সামনের চুলে হাত রেখে একটা দুআ পড়লো।

নীতির আমতা আমতা করে বললো,

"- আসলে দাদীই বলে গেছিল লিখে দিতে। আমি তো জানতাম না আপনি...

অভ্র নীতিকে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে দুষ্টুমি করে বললো,

"- দাদী বলেছিল? নাকি তুমি ভেবেছ লন্ডনে থেকে আমি আমার ধর্ম সম্পর্কে সব কিছু ভুলে বসে আছি। বা কিছুই জানি না।

"- না না বিশ্বাস করুন আমি তেমনটা ভাবিনি। সত্যি বলছি। দাদী না বললে আমি...

অভ্র এবার শব্দ করে হাসলো। বললো,

"- যাক এখন তো সমস্ত দুআ কালাম পড়া শেষ। নাকি আরো কিছু আছে ?

"- হুম।

"- তাহলে আমাকে ফ্রেশ হওয়ার জন্য যেতে দাও।

আর একটা কথা, দাদীর তো সব কথাই মানো দেখছি তাহলে আমার একটা কথা কেন মানো না। নীতি প্রশ্নসুচক দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। তার এই দৃষ্টির মানে, সে অভ্রকে বুঝাতে চাইছে,

(আমি আপনার কোন কথা মানি না)

"- কী, এভাবে তাকাচ্ছ কেন?

কত দিন বলেছি আমাকে আপনি করে না বলতে। রাফিনকে যেমন তুমি করে বলো তেমন আমাকেও তুমি করে বলবে।

নীতি মাথা নিচু করে নিলো।

তাকে দিয়ে অভ্রকে তুমি করে বলাটা হয়তো কোনো দিনও হয়ে উঠবে না।

"- হুম হয়েছে, এখন এই ভারী শাড়ি আর ভারী ভারী গহনা গুলো খুলে স্বাভাবিক একটা জামা পড়ে ঘুমাতে যাও।

অভ্র শেরোয়ানীর পকেট থেকে ছোট একটা বক্স বের করে নীতির হাতে দিল। তারপর শেরোয়ানীটা খুলে হ্যাঙ্গারে রেখে ওয়াশরুমে চলে গেল।

নীতি ছোট বক্সটা হাতে নিয়ে ভাবছে, (" নিশ্চয়ই এটা নিসার জন্য কিনেছিলেন উনি। এখন পরিস্থিতি এটাকে আমার হাতে এনে ফেলেছে") বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো নীতি।

অভ্র টাওয়েল হাতে মাথা মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে এসে ওয়ারড্রোব থেকে একটা টি-শার্ট বের করে পড়তে পড়তে বললো,

"- ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।

"- আপনি কি এখন কোথাও যাচ্ছেন?

"- হুম। আশাকে বলে আসি তোমার জিনিস পত্র গুলো এই রুমে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে।

অভ্র রুম থেকে বের হয়ে গেল।

 

সন্ধ্যা থেকে নীতিরও প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছিল সারাদিনের এতো ধকলের পর শরীর একদম চলছে না। তার উপর কখন থেকে এই আজাব গুলো পড়ে বসে আছে। ভাগ্যিস এশা'র নামায আযানের সাথে সাথেই দাদীর রুমে পড়ে নিয়েছিল। নামাযের পরই তো এসব ঝামেলা শুরু হয়। আর তারপরই পার্লারের মহিলা গুলো এসে এসব পড়িয়ে দিয়ে গেল।

আর সাত পাঁচ না ভেবে সমস্ত গহনা গুলো খোলে রেখে ওয়াশরুমে চলে গেল। সাওয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে রইলো অনেকক্ষণ। শীত গিয়ে গরম চলে এসেছে। দুই দিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে তাই আজ কিছুটা শীত শীত লাগছে। হালকা ঠান্ডাতে গোসল করতে একটুও খারাপ লাগছে না। বরং ভালোই লাগছে। নিজেকে হালকা হালকা মনে হচ্ছে। মাথা ব্যথা টাও কমে গেছে।

 

"- অভ্রডা ঘরে গেছে নাকি জানস?

"- গেছে দাদী। আমি নিজে ভাইয়াকে রুমে যেতে দেখেছি।

"- গেলেও কী হইব, এই গর্দভ ডা বউয়ের কাছে যাইব নাকি?

"- ছিঃ দাদী এসব কী বলছো।

"- ছি ছি করস ক্যান? স্বামী স্ত্রী'র কাছে যাইবো, একটু আদর করবো, সুখ দুঃখের দুইডা কথা কইব, বউরে লইয়া ভালোবাসার সাগরে ডুব দিব। এতে ছি কওনের কী হইলো রে সতীন।

"- আমি এতো কিছু জানি না। তোমার জন্য গরম দুধ এনেছি খেয়ে শুয়ে পড়ো।

আশা প্রতি দিন রাতে ফুলবানু ঘুমিয়ে যাওয়ার আগে দুধ নিয়ে আসে। জহির চৌধুরীর কড়া অর্ডার প্রতি দিন এক গ্লাস করে গরম দুধ খেয়ে তারপরই ঘুমাতে হবে।

"- দুধ খাইয়া আর কী হইবো। আমার সময় ফুরাইয়া আইছে তা তোরাও জানছ আমিও জানি।

"- বাজে কথা বলবে না তো দাদী। তুমি আরো একশো বছর বাঁচবে। এখন তো শবে নাতিকে বিয়ে করিয়েছ। নাতির ঘরের ছেলে মেয়েকে দেখবে না? ফুলবানু হাসতে লাগলেন। এই সংসারে দুই জন মানুষ উনাকে মন থেকে ভালোবাসেন। না দুই জন না তিন জন। অভ্র, আশা আর নীতি। শায়লা চৌধুরীও ভালোবাসেন কিন্তু তা মন থেকে কি-না তা ফুলবানু এখনও ঠিক বুঝে উঠেননি।

"- হ্যারে আশা।

"- কি দাদী।

"- অভ্রের ঘরে উঁকি দিয়া দেইখা আইবি বলদডা কি করে অহন।

"- আমি এসব পারবো না দাদী।

"- আইচ্ছা তাইলে দরজায় কান পাইত্তা একটু শুইন্যা য়া তো হারামজাদাডা বউয়ের লগে ভালোবাসার কথা কয় নাকি?

"- আমাকে ক্ষমা করো দাদী। তুমি যা বলছো এসবের কিছুই আমি করতে পারবো না।

"- মর তুই। দিন দিন বাপের মত খবিশ হইতাছস।

আমার কোনো কথাই তো তুই আর তোর বাপ হুনবি বইলা কিড়া কাটছস।

"- তুমি রাগলেও আমি তোমার এই কথা গুলো শুনতে পারবো না।

শুধু শুধু রাগারাগি না করে একটু বোঝার চেষ্টা করো। আমি বোন হয়ে ভাইয়ার রুমে কীভাবে কান পাতবো, কীভাবে উঁকিঝুঁকি করবো। এটা কি ভালো দেখায় দাদী তুমিই বলো।

"- আমি অতো কিছু বুঝি না। তুইতো আর তোর ভাইয়ের ঘরের খাটের নিচে লুকাইয়া থাকবি না। শুধু দরজার সামনে থেইকা ঘুইরা আবি।

"- দাদী তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তুমি চুপচাপ দুধ খেয়ে ঘুমাও তো। আমি যাচ্ছি। 

------------------------------------------------------------

অভ্র আশাকে খুঁজতে ওর রুমে গিয়ে সেখানে না পেয়ে নিচে চলে আসে। আশা হয়ত বাড়ির এমন পরিস্থিতি দেখে দাদীর কাছে চলে গেছে।

"- আশা! আশা!

"- হুনতো এইডা ওই বদল ডার গলা না?

"- হুম। ভাইয়াই তো ডাকছে মনে হয়। কিন্তু এতো রাতে ভাইয়া আমাকে ডাকছে কেন?

"- গর্দভ, বলদ। শখে শখে কী বলদ কই। বলদের মত কাম করে দেইখাই বলদ কই। মাঝ রাইতে নতুন বউরে একলা রাইখ্যা আশা আশা কইয়া চেচাইতাছে।

অভ্র দাদীর রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো,

"- জানতাম তুই এখানেই থাকবি। তোকে দাদীর রুমেই পাওয়া যাবে।

"- হুম আমাকে তোমার কী দরকার পড়লো এখন।

"- নীতির জিনিস পত্র গুলো আমার রুমে পাঠানোর ব্যবস্থা কর। সকালের মধ্যেই যেন ওর সব কিছু আমার রুমে শিফট হয়ে যায়।

"- আচ্ছা।

অভ্র আশার সাথে কথা শেষ করে দাদীর কাছে গিয়ে দাদীর গাল টেনে দিয়ে বললো,

"- আমার সুইটহার্ট কী করছে এখনও ঘুমায় নি কেন?

"- রাখ তোর সুইটহার্ট। গর্দভ একটা।

"- কী হলো ময়নাপাখি রাত দুপুরে এমন ভাবে ধমকাচ্ছ কেন আমাকে?

"- আমারে সুইটহার্ট,ময়না পাখি, টিয়া পাখি, কাক পাখি না ডাইক্কা তোর বউরে গিয়া ডাক বলদ।

বউরে একলা রাইখ্যা তুই ঘর থেইকা বার হইলি ক্যান?

"- বৌয়ের দরকারেই তো আসছি ময়নাপাখি।

"- হ তাইলে অহন যা।

"- আচ্ছা যাচ্ছি তবে তুমি এখন শুয়ে পড়ো।

অভ্র দাদীর রুম থেকে চলে গেল।

আশাও বের হতে নিচ্ছিল ফুলবানু পেছন থেকে আশাকে ডেকে উঠলো,

"- ছেমরি হুন।

"- কী হইছে বুড়ি।

"- অহন তোরে যেই কাম করবার কমু তা যদি না করছস তাইলে বুঝিস তোর নয়া নাগরের কথা সোজা তোর বাপের কানে তুলমু। একেতো হারাম প্রেম পিরিতি করছ। আবার গুরুজনের কথাও অমান্য করস।

আশা বিরক্তি নিয়ে বললো,

"- তুমি যে আমার উপর দিয়ে কোন জন্মের শোধ তুলছো তা তুমিই জানো।

কোন পাপের শাস্তি ভোগ করার জন্য যে তোমাকে রনিত এর কথা জানিয়ে ছিলাম তা আল্লাহ-ই জানেন।

"- হ বেশি কথা না কইয়া ক আমার কাম করবি কি-না?

"- না করে যাব কই! বলো কী কাজ করতে হবে।

"- এদিকে আয় কানে কানে কই।

 

অনেকক্ষণ ধরে ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে আছে নীতি। ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে প্রথমে ভালো লাগলেও কিছুক্ষণ পর একটু একটু শীত লাগতে শুরু করলো। নীতি ওয়াশরুমে আসার সময় কোনো জামা নিয়ে আসেনি। ওয়াশরুমে এসে দেখে টাওয়েলও নেই। হয়তো অভ্র তখন টাওয়েল রুমে নিয়ে গেছিল। রুমে গিয়ে যে টাওয়েলটা আনবে তাও সম্ভব হচ্ছে না ভেজা কাপড়ের জন্য।

এখন যদি ভেজা কাপড়ে রুমে যায়। আর নীতির শাড়ির পানি দিয়ে রুমে ভিজে গেলে তখন যদি অভ্র রাগ করে।

ভেজা শরীরে থরথর করে কাঁপছে নীতি। গোলাপের পাঁপড়ির মত ঠোঁট দু'টো কেমন নীলচে হয়ে গেছে। হাত পা অবশ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। একেতো ঠান্ডা আবহাওয়া বৃষ্টি হচ্ছে তার উপর ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘন্টা খানিক হবে।

 

অভ্র রুমে ঢুকার সাথে সাথে বাইরে থেকে আশা দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিলো।

"- সরি ভাইয়া। আমার উপর রাগ করিস না প্লিজ। দাদী আমাকে এই কাজটা করতে বলেছে।

তারপরও দাদীর কথা আমি কোনো দিনও শুনতাম না। কিন্তু কী করবো বল রীতিমত দাদীর আমাকে ব্লাকমেইল করেছে। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে এই কাজটা করতে হলো। আজ রাতটা একটু কষ্ট কর প্লিজ। কাল সকাল সকাল খুলে দিয়ে যাব প্রমিস।

"- আশা এমন পাগলামির কোনো মানে হয়?

"- সরি ভাইয়া।

অভ্র রুমে কোথাও নীতিকে দেখতে না পেয়ে ডাকতে লাগলো,

"- নীতি!নীতি! কোথায় তুমি?

এতো রাতে কোথায় গেল মেয়েটা বাইরে গেছে নাকি?

ওয়াশরুম থেকে নীতি কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

"- আমি ওয়াশরুমে।

"- হোয়াট! এখনও তুমি ওয়াশরুমে কী করছো?

"- টাওয়েলটা...

নীতি বলার আগেই অভ্র টাওয়েল বাড়িয়ে দিলো।

"- এই নাও টাওয়েল। তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসো। তুমি তো দেখছি ঠান্ডা লাগিয়ে তারপর শান্ত হবে।

অনেকক্ষণ পরেও যখন নীতি বের হয়ে আসছে না তখন অভ্র দরজায় টোকা দিতে লাগলো,

"- কী হলো এখনও বের হচ্ছো না কেন?

এই এতক্ষণ সময় নিয়ে ওয়াশরুমে কি করছো তুমি?

নীতি! নীতি!

"- আমি বের হতে পারবো না।

"- মানে? নীতি এসবের মানে কি? কেন বের হতে পারবে না তুমি?

"- ভেতরে কোনো কাপড় নেই আমি কী পড়ে বের হব?

অভ্র'র এবার অনেক রাগ লাগছে। ভেতরে কাপড় নেই তা আগে বললে হতো না।

অভ্র ওয়ারড্রোব থেকে নিজের একটা শার্ট আর প্যান্ট বের করে নীতিকে দিলো।

"- এই নাও এগুলো পড়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসো।

এই রুমে তোমার কোন ড্রেস নেই তাই তখন এগুলোই পড়তে হবে। আশা বাইরে থেকে দরজা লক করে দিয়ে গেছে। এখন চাইলেও তোমার রুমে গিয়ে তোমার ড্রেস আনতে পারবো না।

"- আমি আপনার জামা পড়তে পারবো না।

"- মানে? কেন পড়তে পারবে না, হোয়াই?

"- আপনি হয়তো জানেন না। মহিলাদেরকে পুরুষদের পোষাক পড়ার অনুমতি ইসলাম দেয় নি। মহিলারা পুরুষদের মতন সাজতে পারবে না।

হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিশাপ দিয়েছেন সেসব পুরুষকে যারা মহিলাদের সাদৃশ্য ও আকৃতি গ্রহণ করে, আর সেসব নারীদের যারা পুরুষের সাদৃশ্য ও আকৃতি অবলম্বন করে। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫৮৮৫, ৫৫৪৬, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১৯০৪, আবু দাউদ ৪০৯৭]

 

অভ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না।

"- নীতি একটু বোঝার চেষ্টা করো। আমার রুমটা তিনতলার একদম কনারের সাইটে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো রুমটা সাউন্ডপ্রুফ এখান থেকে কাউকে ডেকে মরে গেলেও কেউ শুনতে পাবে না। আর আমার ফোনটাও সাথে নেই। সারা দিনের এসব ঝামেলায় ফোন কোথায় রাখছি তা-ই মনে নেই। আশা দরজা লক করে দিয়ে গেছে। এখন তো তোমার রুমে গিয়ে তোমার ড্রেস আনা সম্ভব না।

"- তারপরও আমি প্যান্ট শার্ট পড়বো না।

"- আরে বাবা বুঝতে চাইছ না কেন? আমি তো ইচ্ছে করে তোমাকে প্যান্ট শার্ট পড়তে বলছি না। তুমি তো বাধ্য হয়ে এগুলো পড়বে, ইচ্ছে করে না। আর তাছাড়া এগুলো পড়ে তো তুমি বাইরে কোথাও যাচ্ছো না। অন্য কোনো পুরুষ বা কারো সামনেই যাবে না।

"- কারো সামনে না যাই। কিন্তু আমি জেনে বুঝে এমন পাপ করতে পারবো না। আমাকে আপনি ক্ষমা করুন প্লিজ।

বলতে বলতেই নীতি কয়েক বার হাঁচি দিয়ে উঠলো। অভ্রের এবার রাগ হচ্ছে।

"- দেখো অলরেডি তোমার ঠান্ডা লেগে গেছে। কম করে হলেও দুই ঘন্টার মত এভাবে আছো তুমি। এখন যদি নিজে থেকে চেঞ্জ করে বাইরে না আসো তাহলে দরজা ভেঙে আমি ভেতরে চলে আসব। আর নিজের হাতে তোমাকে চেঞ্জ করিয়ে দিব। তখন ভালো হবে তো?

"- ইন্নালিল্লা! কী সব বলছেন আপনি?

"- ভালোই ভালোই বলছি চেঞ্জ করে নাও। আল্লাহ কি তোমার এই সিচুয়েশানটা বুঝবেন না? আমি এতবার করে বলছি তবুও তুমি আমার কথা শুনছো। এতো কিছু বুঝো তাহলে স্বামীর কথা অমান্য করছো কেন?

"- ইসলামে যা জায়েজ নেই তা করতে যদি স্বামী আদেশ করে তাহলে সেই আদেশ অমান্য করা যাবে।

 

প্রায় আধা ঘন্টা পার হয়ে গেল। এখন নীতির মাথা সত্যি সত্যিই ঘুরতে শুরু করেছে। নিজের পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ানোর শক্তি আর নেই। একপ্রকার বাধ্য হয়ে আল্লাহর কাছে অনেক দুআ করে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে অভ্রের জামা গুলো নিলো।

"- নীতি ড্রেস চেঞ্জ করতে এতো সময় লাগে নাকি।

দেখো এমনিতেই বৃষ্টির জন্য অনেক ঠান্ডা পড়েছে তার উপর তুমি ভিজে আছো। কিছু একটা হয়ে গেলে কে সামলাবে তোমাকে?

নীতি আস্তে আস্তে বের হয়ে আসলো। শীতে একদম নেতিয়ে গেছে মেয়েটা। সমানে কাঁপছে। ঠোঁট কাঁপার কারনে কিছু স্পষ্ট করে বলতেও পারছে না।

"- ওহ গড! কী অবস্থা করেছো নিজের?

তুমি তো যেকোন সময় সেন্সলেস হয়ে যাবে।

নীতি অভ্রের শার্ট প্যান্ট পড়ে আছে। লজ্জায় অভ্রের সামনে আসতে পারছে না। এক হাতে গলার দিকে শার্টের কলার চেপে ধরে রেখেছে। আরেক হাতে প্যান্ট ধরে রেখেছে। প্যান্টটা এতো লম্বা বারবার পায়ের পাতার নিচে চলে যাচ্ছে। না জানি কখন হোচট খেয়ে পড়ে যাবে এমন অবস্থা। অভ্রের শার্ট প্যান্ট নীতির ফিট আসছে না। আসবে কী করে? অভ্র যেখানে লম্বায় ৬ ফুট ১, নীতি সেখান ৫ ফুট ৩। বডি সাইজের কথা না-ই বললাম। অভ্রের এক শার্টের ভেতরে নীতির মত দু'জন ঢুকতে পারবে। অভ্র নীতির দিকে ঘোর লাগানো চোখে তাকিয়ে আছে।

আচ্ছা এর আগেও তো অভ্র শার্ট প্যান্ট পড়া অনেক মেয়েকে দেখেছে। কই কাউকেই তো ওর এতো ভালো লাগেনি। কারোর শার্টের উপরের খোলা বোতামটা তাকে এতো টানে নি। তাহলে আজ কেন এমন হচ্ছে তার। কী আছে এই মেয়েটার মধ্যে যার কারনে তাকে বাকি সবার থেকে আলাদা মনে হচ্ছে। এই মেয়েটা তার বউ এই জন্যই কি এমনটা হচ্ছে?

 

নীতিকে দেখে অভ্রের হাসি পাচ্ছে আবার কষ্টও হচ্ছে।

এই স্টুপিড মেয়েকে সে বিয়ে করেছে! লন্ডনে থাকতে কত কত মেয়ে যে তার পেছনে পাগলের মত পড়ে ছিল তা সে নিজেও জানে না। শুধু একটা বার তার সাথে ডেটে যাওয়ার জন্য জীবন দিতেও রাজি ছিল। কত মিনিস্কার্টদের যে সে রিজেক্ট করেছে তার হিসাব নেই। কখনও কোন মেয়েকেই সে পাত্তা দেয়নি।

অভ্রের মত হ্যান্ডসাম,ডেসিন,স্টাইলিশ, লম্বা, ফর্সা, বডি ফিটনেস ওয়ালা ছেলে শেষমেশ নীতির মত বোকাসোকা একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে।

অভ্রের বিদেশী মেয়ে বন্ধু গুলো যদি নীতিকে দেখে তাহলে কয়েকজন হয়তো দাঁড়িয়ে থেকেই স্ট্রোক করে মারা যাবে।

অভ্র কোনো দিন কোন মেয়ের দিকে ভালো করে তাকায় নি। যদি কখনো ভুল করে কারো দিকে চোখ চলে গেলে সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিয়েছে অভ্র। তবে আজ কেনই যেন এই মেয়েটার উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারছে না। সব কিছু বাদ দিয়ে শুধু ওর দিকেই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে ওকে ছুঁয়ে দেখতে। ওর কাঁপা কাঁপা ঠোঁট জোড়া আলতো করে ছুঁয়ে দিতে। তাহলে এটাই কি স্ত্রীর প্রতি স্বামী মোহাব্বাত? কবুল বলার পরপরই কি আল্লাহ স্ত্রীর জন্য স্বামীর মনে এই ভালোবাসা তৈরি করে দেন?

অভ্র মনে মনে বললো,

("-ওকে নিয়ে এমনটা ফিল করা কি ঠিক হচ্ছে? হবে না কেন সে তো এখন আমার বিয়ে করা বউ। সমস্ত নিয়মরীতি মেনে আমি ওকে বিয়ে করেছি। নিজের বউকে টাচ করলে কি অন্যায় হবে?

হুম অবশ্যই হবে, কারন যতই আমি ওকে বিয়ে করি না কেন সে যদি আমাকে স্বামীর অধিকার দিতে না চায় তাহলে তাকে টাচ করলে সত্যিই খুব বড় অন্যায় হবে। হয়তো পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে সে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে কিন্তু মন থেকে আমাকে মেনে নেয়নি। কী ভাবছি আমি এসব? আমি কি ওর কথা ভাবতে ভাবতে পাগল হয়ে যাচ্ছি নাকি? এই মেয়ে আমার মনে এমনকি আমার মাথায়ও জেঁকে বসেছ।")

অভ্র হেসে ফেললো।

"- কী হলো এখনও দাঁড়িয়ে আছো কেন?

ঘুমাবে না?

"- আমি কোথায় ঘুমাবো?

"- হোয়াট?

কোথায় ঘুমাবে মানে?

"- না মনে...

"- অবশ্যই তুমি বেডে ঘুমাবে।

"- তাহলে আপনি কোথায় ঘুমাবেন?

"- ইডিয়টদের মত কথা বলছো কেন?

এতো বড় বেড আমার দু'জনই এখানে ঘুমাতে পারবো।

নীতি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে,

"- আমার সাথে এক বেডে ঘুমাতে তোমার কোনো প্রব্লেম আছে কি?

না যদি প্রব্লেম থাকে তাহলে বলতে পারো।

আর তাছাড়া এখন আমরা হাজবেন্ড ওয়াইফ। সো লিগ্যালি আমরা এক বেডে থাকতে পারবো।

নীতি জানে সে অভ্রের সাথে তর্ক করে পারবে না। যে ছেলে বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে এসেছে সে কীভাবে পারবে তার সাথে। সে তো কোনমতে এইচএসসিটা দিয়েছে।

নীতি গিয়ে বিছানা গোছাচ্ছে। মনে মনে ভাবছে,

"- আমি উনার সাথে এক বিছানায় কী করে ঘুমাবো? উনি বাড়ির মালিক আর আমি সামান্য কাজের লোক। আমার উপর দয়া করে উনি আমাকে বিয়ে করলেও আমাকে উনার স্ত্রী হিসেবে কোনো দিনও মেনে নিবেন না তা আমি জানি।

বাধ্য হয়ে কত ভালো ভালো মেয়ে থাকতে উনাকে আমার মত একটা অনাথ কাজের মেয়েকে বিয়ে করতে হলো।

নীতি মনে মনে কষ্ট পাচ্ছে। সব মেয়েদেরই নিজের স্বামীকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে। তারও ছিল। আল্লাহর কাছে এমন একজনকে জীবন সঙ্গী হিসেবে চাইত যে তাকে বুঝবে, ভালোবাসবে, ওর যোগ্য সম্মানটুকু দিবে। সারা জীবন আগলে রাখবে।

কিন্তু নীতির সেই ভাগ্য হলো না। এমন একজনের সাথে এমন এক পরিস্থিতিতে ওর বিয়েটা হলো যা ও কখনো আশা করেনি। তারপ

331 Views

Comments


meghpalok 3 years ago

nice

 
  • Like
  • Love
  • HaHa
  • WoW
  • Sad
  • Angry