মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দিন আহমেদ এর ভূমিকা


ইতিহাসের পাতায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের রাজনীতি

গত একদশক ধরেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ এবং সরকার প্রধান থেকে প্রতিটি সিনিয়র আওয়ামীলীগ নেতাদের মুখে মুখে উচ্চারিত হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা আর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার এবং বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে স্বাধীনতা বিরোধীতের উৎখাতের কথা। কিন্তু পরপর তিনমেয়াদে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ সংসদে একক সংখ্যা গরিষ্ঠ দল হওয়া সত্ত্বেও কেনোই আইন করে নিষিদ্ধ করেনি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশকে সে আলোচনায় না হয় পরে যাচ্ছি আগে আমার এই ক্ষুদ্রজ্ঞানের আলোকে মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দিন আহমেদের ভূমিকা নিয়েই আলোচনা করছি। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে কিন্তু ১৯৭১ সালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবেনা ফিরে যেতে হবে ১৯৫২এর মহান রাষ্ট্র আন্দোলনে ভাষা শহীদদের আত্মবলিদানের স্মৃতিকথায়। মূলত ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে বপন করা হয়েছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ এবং ১৯৪৯ সালে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশদের হাতধরে তৎকালীন পাকিস্তানে ধর্মনিরপেক্ষ ও উদার বামঘেষা একটা রাজনৈতিক দল পাকিস্তান আওয়ামীলীগ এর গঠন 1954 সাধারণ নির্বাচন, 1956 এর যুক্তফ্রন্ট গঠন করে তৎকালীন পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠ, ১৯৬৬ এর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয়দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সামরিক স্বৈরাচার জেনারেল আইয়ুব শাসনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচন আদায় এবং ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া শহীদ আসাদের রক্তই ওই নির্বাচনে নিরুঙ্কুশ সংখাগরিষ্টতা এনে দিয়েছিলো আওয়ামীলীগকে যা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পূর্ববাংলার জনগনের ম্যান্ডেড হিসেবে ধরা হয়েছিলো। ১৯৭০ এর নির্বাচনের পর তৎকালীন পাকিস্তানের শাসকবর্গ স্পষ্টতই উপলব্দি করতে পেড়েছিলো বাঙালিদের আর দাবিয়ে রাখা যাবেনা তাই সত্তর নির্বাচনে বিজয় লাভ করার পরও আওয়ামীলীগকে সরকার গঠন করার সূযোগ না দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করতে থাকে, এদিকে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এসেম্বলি কল করার একাধিক তারিখ ঘোষণা করেও এসেম্বলি কল না করে কালক্ষেপণ করতেছিল, এমনি করে ১৯৭১ এর মার্চে বঙ্গবন্ধু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য তৎকালীনপাকিস্তান সরকারের উপর  চাপ প্রয়োগের জন্য অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তুলেন এবং ১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান তথা বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক ভাষণ দান করেন, তিনি বলেছিলেন "এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, " এই ভাষণে তিনি ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলে বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন কিন্তু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সাথে আলোচনার রাস্তাও খোলা রেখেছিলেন অন্যদিকে, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে গোপনে সেনা সংখ্যা বৃদ্ধি ও অস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুদ বাড়ানো শুরু করেছিল। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসে একাত্তরের তেইশে মার্চ এবং এটা ছিলো এই জনপদের দৃষ্টি এড়িয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিপুলসংখ্যক সেনা ও গোলাবারুদ আনার একটা কৌশলমাত্র, বঙ্গবন্ধুও তা টের পেয়ে গিয়েছিলেন এবং তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ আওয়ামীলীগের সকল সিনিয়র নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন সন্ধ্যার পর এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী করণীয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন, বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহযোগী তৎকালীন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধুকে আত্মগোপনে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার অনুরোধ করতে থাকেন কিনতু বঙ্গবন্ধু আত্মগোপনে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিলেন "আমাকে তোরা কই লুকিয়ে রাখবি, আমাকে না পেলে ওরা আমার নিরীহ জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করবে " এর পরিবর্তে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাজউদ্দিন আহমেদকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়ীত্ব দিয়ে আত্মগোপন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। একে একে সকল সিনিয়র নেতৃবৃন্ধ বঙ্গবন্ধুর কাছথেকে বিদায় নিলেও অপারেশন সার্চলাইট নামক পাকিস্তানি হায়েনাদের নারকীয় গণহত্যা অভিযান শুরুর আগপর্যন্ত তাজউদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধু সঙ্গ ত্যাগ করেন নি,ততোক্ষণে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর সড়কে পাকিস্তানি আর্মির কনভয় উপস্থিতি শুরু হয়ে গেছিলো, মগবাজারে পাকিস্তান আর্মিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বাঙালি অফিসার ও কনস্টেবলরা তুমুল যুদ্ধে 152 জন পুলিশ সদস্য শহীদ হয়েছিলো। তাজউদ্দিন আহমেদ তার ঘনিষ্ট অনুচর ও বন্ধু ব্যারিস্টার সৈয়দ আমির-উল-ইসলাম এবং ডঃ কামাল হোসেন একই গাড়িতে করে আত্নগোপনের উদ্দেশ্যে হোটেলে ইন্টার কণ্টিনেন্টালের সামনে দিয়ে বিকল্প পথ অনুসরণ করে মিলিটারি কনভয়কে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু ধানমন্ডির সীমানা পেরুনোর আগেই ডঃ কামাল গাড়ি থেকে নেমে যান এবং ব্যারিস্টার আমির-উল-ইসলাম এবং বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমেদ ধানমন্ডি পেড়িয়ে অবাঙালি অধ্যুষিত মোহাম্মদপুর এলাকায় জনৈক এক বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নেন এবং ঐ বাড়িতেই রাত্রি যাপন করেন এবং পরের দিন সকালে পাকিস্তানি আর্মি কার্ফিউ শিথিল করলে বাজারের থলে হাতে নিয়ে রহমত আলী ও কেরামত আলী নামক ছদ্ধ নাম ও ছদ্ধবেশ ধারণ করে কেরানীগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে পালিয়ে যেতে থাকা বিশাল জনস্রোতের সাথে মিশে গেলেন এবং যাত্রাপথে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়ে, মুন্সিগঞ্জ হয়ে ফরিদপুর পৌঁছেন 27 শে মার্চ এবং সেদিন 70 এর নির্বাচনে বিজয় লাভ করা এক আওয়ামীলীগ নেতার বাড়িতে রাত্রি যাপন করে ২৮ শে মার্চ ১৯৭১ পদ্মানদী পাড়ি দেয়ার সময় তাজউদ্দিন আহমেদ ও ব্যারিস্টার সৈয়দ আমির-উল-ইসলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত মেজর জিয়াউর রহমানের নিম্নোক্ত ঘোষণাটি শুনতে পান " I major ziaur Rahman here by declare the indepency of the People Republic of Bangladesh by the name of great leader Bangabandhu Sheikh Mujibur Raman. I call up on all bangalee to raise against Pakistan army, we'll fight our last, victory is by the grace of Allah." বঙ্গতাজের ঘনিষ্ট সহচর ব্যারিস্টার আমির-উল-ইসলাম ইসলাম তাঁর "মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা " নামক গ্রন্থে একথা উল্লেখ্য করেন যে মেজর জিয়ার এই ঘোষণা তৎকালীন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়া বাঙালিদের মনে অনুপ্রেরণা সঞ্চার করেছিল এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সংঘবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিলো। তারপর বঙ্গতাজ মার্চের 28 তারিখ পদ্মা পাড়ি দিয়ে 30 তারিখে কুষ্টিয়ার মেহেরপুর সীমান্তে পৌছান এবং মেহেরপুর মহকুমাশাসক তৌফিক-ই-ইলাহী তাদের সীমান্ত অতিক্রম করতে সহায়তা করেন এবং সীমান্ত অতিক্রম করার পর তৎকালীন বিএসএফ এর আঞ্চলিক কমান্ডার শ্রী গোলক মজুমদার তাদের যথাযোগ্য মর্যাদায় গ্রহণ করেন এবং তাদের বিশ্রাম রাতের খাবার ও নতুন জামা কাপড়এর ব্যবস্থা করেন। জনাব তাজউদ্দিন বিএসএফ এর পরিচালক মেজর জেনারেলরুস্তমজীর সাথে সাক্ষাৎ করেন মিঃ মজুমদারের সহযোগিতায় এবং জনাব তাজউদ্দিন রুস্তমজীকে বাঙালিদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করলে প্রতিউত্তরে বিএসএফ মহাপরিচালক বলেছিলো তা তখনই সম্ভব যখন ভারত সরকার তার অনুমোদন দিবে। তারপর বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন লেঃ কর্ণেল গোলক মজুমদারের সহযোগিতায় মিলটারীর জন্য পনুবহনে নিয়োজিত এক বিশেষ বিমানে করে ভারতের তৎুকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে দিল্লী পৌছান এপ্রিল এর তিন তারিখে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার প্রধানের প্রটোকল নিয়েই তিনি শ্রীমতী গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বলেন বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অধিকাংশ  অঞ্চলই মুক্তাঞ্চল, ভারতীয় সীমান্তে কোটি কোটি বাঙালি অবস্থান করছে যাদের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, ইপি আর, পুলিশ এর বাঙালি সদস্য এবং অনেক তরুনও রয়েছে, তাদের অস্ত্র গোলাবারুদ ও প্রশিক্ষণের স্থান দিয়ে সহযোগিতা করার অনুরোধ রাখেন এবং সীমান্তখুলে দেয়ার আহবান করেন। আরেকটি অনুরোধ করেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসের সাহায্যে পাকিস্তানের উপর আন্তর্জাতিক চাপ তৈরী করতে যাতে সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর বিচার করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে না পাড়ে পাকিস্তা। মিসেস গান্ধী মন্ত্রমুগ্ধের মতো সব শুনছিলেন এবং তিনি ও তার সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে বঙ্গতাজকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন। এবং সে অনুযায়ী জনাব তাজউদ্দিন 70 এর নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিটি জনপ্রতিনিধিকে আগরতলা সার্কিট হাউজে সমবেত হওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন এবং দিল্লী থেকে একটি ছোট বিমানে করে 1971 সালের এপ্রিলের 9 তারিখে তিনি আগরতলা পৌছান এবং সরকার গঠনের ব্যাপারে তিনি আওয়ামীলীগ এর সিনিয়র নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন। শেখ মনি ও খন্দকার মুশতাক সরকার গঠনের বিরোধিতা করে। তারপরজ জনাব তাজউদ্দিন সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বুঝিয়ে বলল্লে সবাই একমত হয় তারপর আওয়ামীলীগের বর্ষিয়ান নেতা হিসেবে খন্দকার মুশতাক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আশাবাদ পোষণ করলে তাজউদ্দিন আহমেদ এর পক্ষে ব্যারিস্টার আমির-উল-ইসলাম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নাম প্রস্তাব করলে তা গৃহীত হয় এবং ১৯৭১ সালের ১০ ই এপ্রিল গঠিত হয় স্বাধীন গগণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এর প্রথম স্বাধীন সরকার যার কাঠামো নিম্নরূপ ঃ রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমা, অস্থায়ীরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, মন্ত্রী ক্যাপ্টেনমুনসুর আলী, মন্ত্রী কে এম কামরুজ্জামান, এবং মন্ত্রী খন্দকার মুশতাক আহমেদ, সেনাবাহিনী প্রধান আতাউল গণি ওসমানী। ইতিহাসে এই সরকার প্রবাসী সরকার হিসেবে পরিচিত এবং চারটি প্রধান মূলনীতিকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি রেখে 1971 সালের 14 এপ্রিল মেহের পুরে বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে  দেশী বিদেশী 50 জনের বেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে 5000 এর বেশি মানুষের উপস্থিতিতে শপথ নেয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার এবং  চারটি মূলচেতনাকে সামনে রেখে পরিচালিত হয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধ আর সে সে চেতনাগুলো হলো একঃ গণতন্ত্র, দুইঃ সাম্য ও আইনের চোখে সমান অধিকার তিনঃ সসমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চারঃধর্মনিরপেক্ষতা  (চলবে)                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                      

403 Views

Comments