গরমে হিম হিম আইসক্রিমের গল্প


আইসক্রিম শব্দটি শুনলেই চৈত্রের দাবদাহের মধ্যেও কী যেন এক শীতল পরশ বয়ে যায় দেহ–মনে।

.

হিমায়িত মিষ্টিজাতীয় খাবারটি ছেলে-বুড়ো সবারই যে খুব প্রিয়, তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ দিয়েছেন বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তাঁর মতো প্রকাশ্যে একটার পর একটা না খেলেও আইসক্রিমের প্রতি বুড়োদেরও যে বেজায় আকর্ষণ আছে, সেটা না বললেও চলে। শিশুদেরও প্রিয় খাবার আইসক্রিম!

আইসক্রিমের আদি গল্প কিন্তু অতি প্রাচীন বলে জানা যায়। চায়না, ইরান, ইতালি, গ্রিস, ভারত সব দেশেরই আছে আইসক্রিম নিয়ে নিজস্ব ইতিহাস। তবে সব অঞ্চলেই প্রাচীনকালে মানুষকে আইসক্রিমের জন্য পাহাড় থেকে আনা বা হিমায়িত জলাশয় থেকে খুঁড়ে নেওয়া বরফের ওপরে নির্ভর করতে হতো। সংগৃহীত বরফ বিশেষ উপায়ে হিমাগারে সংরক্ষণ করা হতো। তাই বরফের দুষ্প্রাপ্যতার জন্য আইসক্রিম জনসাধারণের নাগালের বাইরেই ছিল বলা যায়।

এরপর যখন আঠারো শতকে রেফ্রিজারেটরে বরফ জমানোর কায়দা জানা গেল, তখনই প্রথম সাধারণ মানুষ কনকনে ঠান্ডা আইসক্রিমের স্বাদ পেল। এরপর যখন উনিশ শতকে আইসক্রিম বানানোর মেশিন আবিষ্কার হয়ে গেল, তখন এই ক্রিমি স্বাদের আধুনিক যুগের চিরচেনা আইসক্রিম যুগের শুভসূচনা ঘটল। তবে সত্যি কথা বলতে গেলে, সাধারণভাবে আমরা সব ধরনের ফ্রোজেন ডেজার্ট বা হিমায়িত মিষ্টিজাতীয় খাবারকেই আইসক্রিম বললেও এগুলোর আছে বৈচিত্র্যময় রকমফের। তাই ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ পাশে রেখে এবার বরং প্রধান কয়েকটি হিম হিম আইসক্রিমের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক।

শেভড আইস বা কুচো বরফের আইসক্রিম

বরফকে কুরিয়ে মিহি তুষারের মতো পেঁজা ভাব এনে তাতে ফলের রস, বিভিন্ন পানীয়, সিরাপ, রকমারি ফ্লেভার ইত্যাদি মিশিয়ে প্রথমে হিমায়িত মিষ্টি খাবারের চল হয়েছিল। অঞ্চলভেদে এতে দুধ, বিভিন্ন ফল, বাদাম, মধু, জেলি, গম, চালের আটা বা সাবুর তৈরি বুন্দিয়া, সেমাই বা ফিরনির মতো খাবারও মেশানো হতো। কুচানো বরফ দেওয়া এমন সব মিষ্টি খাবারের মধ্যে প্রসিদ্ধ হচ্ছে পারস্য ও আমাদের উপমহাদেশের ফালুদেহ বা ফালুদা, ফিলিপাইনের হালো হালো, জাপানি কাকিগোরি ইত্যাদি। তবে এগুলো ঠিক সে অর্থে আইসক্রিম নয়। বরং পাশ্চাত্য দেশে স্নো কোন বা স্নো বল এবং আমাদের অঞ্চলের গোলা বা চুস্কি আইসক্রিমে কুচানো বরফ চেপে চেপে আকৃতি দিয়ে তাতে বিভিন্ন ফলের রস, রঙিন সিরাপ দিয়ে খাওয়া হয় যুগ যুগ ধরে। আমাদের দেশে সেই চল্লিশ-পঞ্চাশের দশক থেকেই এই গোলা আইসক্রিম খুবই জনপ্রিয়।

আইস ললি বা কাঠি আইসক্রিম

ফলের রস বা দুধ জমিয়ে বরফ করে নিলেই পপসিকল, আইস ললি বা সোজা বাংলায় কাঠি আইসক্রিম হয়ে যায়। এই আইসক্রিমের শুরুর গল্পটি কিন্তু ভারি মজার। সেই ১৯০৫ সালে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলের ১১ বছর বয়সী ছোট এক ছেলে তার পানিতে গোলানো পাউডার সোডার গ্লাসটি একটি নাড়নকাঠিসহই বাইরে ফেলে গিয়েছিল ভুলে। বরফে ঢাকা সেই স্থানে রাখা গ্লাসটির পানীয় তীব্র ঠান্ডায় জমে একেবারে বরফ হয়ে গিয়েছিল। পরদিন বেরিয়ে কাঠিসহ সেই মিষ্টি মজাদার বরফ খেয়ে অভিভূত কিশোর ফ্র্যাংক এপারসন বড় হয়ে পপসিকলের পেটেন্ট নিয়ে তা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রয়ের সূচনা করেছিলেন।

এ ধরনের আইসক্রিম আমাদের দেশে সেই ষাটের দশক থেকেই পাওয়া যায়। বিভিন্ন রং ও ফ্লেভার দেওয়া চিনি-পানি বা দুধ জমিয়ে বাঁশের চ্যাপ্টা কাঠি দেওয়া আইসক্রিম সবার খুব প্রিয় ছিল। পরে অরেঞ্জ ফ্লেভার, লেমন ফ্লেভার, ওভালটিন দুধ আর নারকেল দুধের বেবি আইসক্রিম কোম্পানির আইস ললি খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠল এ দেশে। এ পথ ধরে ষাটের দশকে ইগলু এসে দেশের আইসক্রিম জগৎটি পাল্টে দিল একেবারেই। পরে ধীরে ধীরে দেশের আনাচকানাচে সব জায়গায় জনপ্রিয় হয়ে উঠল এবং সুলভে মিলতে লাগল কাঠি আইসক্রিম বা আইস ললি।

কুলফি

ঘন দুধ, মালাইয়ের সঙ্গে চিনি, এলাচিগুঁড়া, গোলাপের নির্যাস, পেস্তা, কাজু, কিশমিশ, কাঠবাদাম এবং ক্ষেত্রবিশেষে আমের মসৃণ ঘন ক্বাথ মিশিয়ে আইস ললির প্রক্রিয়াতেই ছাঁচে জমিয়ে কুলফি বানানো হয়। তবে এ ক্ষেত্রে দুধের মিশ্রণটি খুব ঘন হওয়ার ফলে এই বরফ জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াটি কিছুটা ধীরগতির হয়। এতে করে কুলফির বিশিষ্ট মসৃণ ক্রিমি ব্যাপারটি সাধারণ দুধের কাঠি আইসক্রিমের চেয়ে বেশি পাওয়া যায়। কুলফি আসলে ফারসি শব্দ, যার অর্থ ঢেকে রাখা বা আচ্ছাদিত। কুলফি আসলেই ঢাকা ধাতব ছাঁচেই জমানো হয় যুগ যুগ ধরে।

জানা যায় যে উপমহাদেশে ষোলো শতকে মোগল প্রভাবেই প্রথমে কুলফির প্রচলন হয়। একেবারেই রাজকীয় স্বাদের এই হিমায়িত মিষ্টান্ন ধাতব ছাঁচে পুরে তাপনিরোধী বড় বাক্সে বরফ আর লবণের মিশ্রণে ডুবিয়ে রেখে জমানো হতো। এই লবণের কাজ হচ্ছে কুলফির ছাঁচটিকে ঘিরে রাখা বরফের হিমাঙ্কে নামিয়ে এনে কুলফি ভালোভাবে জমাতে সাহায্য করা। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ভারতীয় উপমহাদেশে বরফকল প্রতিষ্ঠার পর আমাদের দেশে ত্রিশ-চল্লিশের দশক থেকে বড় মাটির মটকায় লবণ-বরফে চুবানো কুলফি পাওয়া যায় দেদারসে। আজকাল আর আধুনিক আইসক্রিমের দৌরাত্ম্যে মালাইয়ে ভরপুর মটকা কুলফির দেখা মেলা ভার।

আইসক্রিমের আবেদন আসলে শুধু সর্বজনীন নয়, একেবারে বিশ্বজনীন। গরমকালে হিমশীতল আইসক্রিমের তুলনা আর কিছুর সঙ্গেই দেওয়া যায় না। আইসক্রিম প্রিয়জনের মুখে নিমেষেই হাসি ফোটাতে পারে সুলভে। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল, জন্মদিন বা যেকোনো খুশির খবর আইসক্রিমের সঙ্গে উদ্‌যাপিত হলে যেন খুশি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। তাই চলুক হিম হিম আইসক্রিমের জাদু, ভরে যাক খুশি সবার জীবনে।

 

Comments