জয়নুল আবেদিন


কথা বলে যার ছবি, তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। আমাদের চিত্রকলার পথিকৃত।

.

মানবতাবাদী  শিল্পী জয়নুল আবেদিনের জন্মদিন আজ। আমাদের গর্বের ধন আছেন যতজন। তার মধ্যে শিল্পাচার্য অন্যতম। বাংলাদেশের শিল্পজগতের দুয়ার খুলতেই জ্বলজ্বল করে ওঠে যার নাম। তিনি জয়নুল আবেদিন। তিনিই আমাদের চিত্রকলা ও লোকশিল্পের বর্ণাঢ্য ইতিহাসের রূপকার। আমাদের শিল্পাচার্য।

জয়নুল আবেদিন ছিলেন আমাদের সেই প্রকৃত আলোকবর্তিকা, যিনি শুধু পথ প্রদর্শনই নয়, পথকে নিজ হাতে গড়ে দিয়ে গেছেন আমাদের জন্য; এই বাংলাদেশের জন্য। তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত ডিলিট প্রাপ্তির ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমার সমস্ত জীবন ও কর্ম নিবেদিত ছিল একজন সম্পূর্ণ মানুষ হওয়ার পথে।’ শিল্প ও চেতনার স্ফুরণে জয়নুল আবেদিন আমাদের মননজগৎকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন অনবরত। তিনি আমাদের সেই বাতিঘর, যেখান থেকে আমরা দেখি গণমানুষের হাজার বছরের আর্তিকে। অফুরান সেই আলো।

১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের কেন্দুয়ায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা তমিজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন পুলিশের দারোগা। মা জয়নাবুন্নেছা গৃহিণী। নয় ভাইবোনের মধ্যে জয়নুল আবেদিন ছিলেন সবার বড়। পরিবারের কাছেই তার পড়াশোনায় হাতেখড়ি। খুব ছোটবেলা থেকেই তিনি ছবি আঁকা পছন্দ করতেন। পাখির বাসা, পাখি, মাছ, গরু-ছাগল, ফুল-ফলসহ আরো কত কি এঁকে মা-বাবাকে দেখাতেন। ছেলেবেলা থেকেই শিল্পকলার প্রতি তার গভীর আগ্রহ ছিল। মাত্র ষোল বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে কলকাতায় গিয়েছিলেন কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখার জন্য। কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখে আসার পর সাধারণ পড়াশোনায় জয়নুল আবেদিনের মন বসছিল না। তাই ১৯৩৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই কলকাতায় চলে যান এবং মায়ের অনুপ্রেরণায় তিনি গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসে ভর্তি হন। ছেলে জয়নুল আবেদিনের আগ্রহ দেখে নিজের গলার হার বিক্রি করে ছেলেকে কলকাতার আর্ট স্কুলে ভর্তি করান। পরবর্তীতে ছেলে জয়নুল আবেদিনও মায়ের সেই ভালোবাসার ঋণ শোধ করেছেন দেশের স্বনামধন্য শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। জয়নুল আবেদিন ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে পড়েন। ১৯৩৮ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসের ড্রইং এন্ড পেইন্টিং ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার জন্য সারা বিশ্বের কাছে খ্যাতি অর্জন করেন জয়নুল আবেদিন। পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে নৌকা, ১৯৫৯ সালে সংগ্রাম, ১৯৬৯ সালে নবান্ন, ১৯৭০ সালে ‘মনপুরা-৭০, ১৯৭১ সালে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা, ইত্যাদি ছবিগুলো এঁকে শিল্পের সর্বোচ্চ শিখরে নিজেকে উন্নীত করেন শিল্পাচার্য। এছাড়া ‘সাঁওতাল রমণী, ঝড় ইত্যাদি ছবিগুলোও অন্যশিল্পীদের চেয়ে তাকে আলাদা করে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে একটি শিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুভূত হয়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালে পুরান ঢাকার জনসন রোডের ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলের

একটি জীর্ণ বাড়িতে মাত্র ১৮ জন ছাত্র নিয়ে গভর্নমেন্ট আর্ট ইনস্টিটিউটের যাত্রা শুরু হয়। শিল্পাচার্য ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। ১৯৫১ সালে এটি সেগুনবাগিচার একটি বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৫৬ সালে গভর্নমেন্ট আর্ট ইনস্টিটিউটকে শাহবাগে স্থানান্তর করার পর ১৯৬৩ সালে এটি একটি প্রথম শ্রেণির সরকারি কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তখন এর নামকরণ করা হয় পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়। স্বাধীনতার পর এটি বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় নামে পরিচিতি পায়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ১৯৪৯-১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর এই সরকারি কলেজটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সোনারগাঁওয়ে লোকশিল্প জাদুঘর ও ময়মনসিংহে গড়ে তোলেন জয়নুল সংগ্রহশালা। ১৯৭৬ সালের ২৮ মে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরলোকে পাড়ি জমান বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রশিল্পের এই পথিকৃত।

 

 

Comments