ফতেহপুর সিক্রি


ফতেহপুর সিক্রি নামের সঙ্গে সম্রাট আকবরের নাম জড়িত।

.

ফতেহপুর সিক্রি নামের সঙ্গে সম্রাট আকবরের নাম জড়িত। যদিও শহরটির ইতিহাস আরও পুরোনো। আকবরের দাদা সম্রাট বাবর জায়গাটির নাম সিক্রি রাখেন। সীমান্ত অঞ্চলে সংগ্ৰাম সিংহের সাথে যুদ্ধের সময়ে বাবরের সৈন‍্যরা এখানকার শুকরী ঝিলের পানি ব‍্যবহার করতো। সেই যুদ্ধে বাবরের জয় হয়েছিল। তাই আল্লাহকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন অর্থাৎ শুকরিয়া জানানো থেকে সিক্রি নামকরণ হয়।

সে সময় বাবর এখানে প‍্যাভিলিয়ন ও বাগিচা গড়েন। বাগানের নাম দিয়েছিলেন ‘বিজয় উদ‍্যান’। গুলবদন বেগমের ‘হুমায়ূননামা’তে লেখা আছে, বাবর সেই বাগানে একটি আটকোণা চাতাল বানিয়েছিলেন। যা তিনি বিনোদন ও লেখার জন্য ব‍্যবহার করতেন। একটি ঝিলের মাঝখানে একটি বেদীও নির্মাণ করেছিলেন। কিছুটা দূরে একটি পাথরের চড়াই ছিল, যার তলায় বালি ছিল। এখানে একটি পাথরের ফলকে খোদাই করা ছিল বাবরের বিজয়ের ইতিহাস। পরবর্তীতে যত্নের অভাবে তা নষ্ট হয়ে যায়।

এরপর আকবর যখন সন্তানের আশায় বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন; তখন একদিন জানতে পারেন যে বাবরের নামকরণ করা সেই জায়গায় এক অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন ফকির আছেন। তার আশীর্বাদে ‘অপুত্রের পুত্র হয় আর নির্ধনের ধন হয়’। আকবর তখন ফকিরের কাছে আগ্ৰা থেকে পদব্রজে গিয়ে ধরনা দেন। ফকির তখন আকবরের আরজি শুনে আশীর্বাদ করেন। এর কিছুদিন পরই আকবরের স্ত্রী যোধাবাঈ সন্তানসম্ভবা হন। আকবর তখন সেই গ্রামে রানীর জন্য একটি ঘর নির্মাণ করেন। ১৫৬৯ সালের ৩০ আগস্ট তাদের পুত্র জন্ম নেয়। ফকির ‘শেখ সেলিম চিস্তি’র নামানুসারে আকবর ছেলের নাম রাখেন সেলিম।

আগ্রা শহর থেকে ৩৯ কিলোমিটার দূরের গ্রামটি আকবরের পচ্ছন্দ হয়। সেলিমের জন্মে খুশি হয়ে আকবর এখানে নতুন মহানগরী স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। নগরীর নাম হয় ‘ফতেহবাদ’। যা পরবর্তীতে ‘ফতেহপুর সিক্রি’ নামে পরিচিত হয়। আকবরের প্রতিষ্ঠিত ফতেহপুর সিক্রি ছিল শিল্পী ও গুণী ব্যক্তিদের আদর্শ স্থান।

আকবর পূর্বপুরুষ তৈমুরের মতো পারসিক আদলের সঙ্গে স্থানীয় আদলের মিশ্রণ ঘটিয়ে এক যুগান্তকারী স্থাপত্যকলার প্রচলন করেন। মাইল দুয়েক লম্বা এবং মাইল খানেক চওড়া ফতেহপুরে নতুন রাজধানী গড়ে ওঠে। শহরের চৌহদ্দি প্রায় দশ কিলোমিটার। ইংরেজ পর্যটক র্যালফ ফিচ ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে শহরকে লন্ডন শহর অপেক্ষা বৃহৎ ও জনবহুল বলে বর্ণনা করেন। তিন দিক প্রাচীরে ঘেরা- নয়টি গেট, চতুর্থ পাশে তৈরি করা হয়েছিল কৃত্রিম লেক। নয়টি দরজা হলো- বুলন্দ, দিল্লি, লাল, আগ্রা, বীর পোল, চাঁদ পোল, গোয়ালিয়র, টেরা এবং আজমিরি দরজা।

আগ্রার দিক থেকে এলে প্রথমে পড়বে আগ্রা দরজা। এটি পার হয়ে এগিয়ে সামনে নহবতখানা। সে সময়ের চহার-সুখ। তার ভেতর দিয়ে রাজপথ। ডানে একটি সড়ক। যা দিয়ে এগিয়ে গেলে তানসেন বারাদরী, তানসেনের আবাস। এসব কয়টা দরজার মধ্যে প্রধান হলো বুলন্দ দরজা। ১৫৭৩ সালে আকবর গুজরাট বিজয়ের স্মৃতিতে এটি তৈরি করেছিলেন।

ফতেহপুর সিক্রি নির্মাণের জন্য খরচ হয়েছিল ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এতে ২ হাজার ৯০০টি অট্টালিকা ছিল। সে সময় ফতেহপুর সিক্রি দুর্গে ৬০ হাজার সৈন্য বাস করতো। দিল্লির লালকেল্লা বা আগ্ৰা কেল্লার চেয়ে ফতেহপুর সিক্রির আকার অনেক বড় এবং অনেক জাঁকজমকপূর্ণ ছিল।

আকবর ফতেহপুর সিক্রির প্রধান দরজা বুলন্দ নির্মাণ করেছিলেন দক্ষিণাত‍্য, বিশেষ করে গুজরাট বিজয়ের প্রতীক হিসেবে। এটি বিশ্বের বৃহত্তম দরজা। বুলন্দ দরজা মানে বড় দরজা। বলা হতো, এত বড় দরজা দিয়ে মানুষ কেন, হাতিও প্রবেশ করতে পারে। দরজাটি খুলতে একসাথে কুড়ি-পঁচিশ জন সৈনিক দরকার হতো।

রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করার জন্য দরজাটি তৈরি হতে এক বছরের মতো লেগেছিল। প্রায় চল্লিশ ফুট উঁচু বেদীর উপর বুলন্দ দরজাটির উচ্চতা ৫৪ মিটার। দরজাটি এমন স্থানে; যেখানকার জমির ঢালের জন্য সোপান নির্মাণ জরুরি ছিল। যার ফলে এ সোপানযুক্ত দরজা তার নিজের গঠনশৈলীতে আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছে।

দরজাটির সামনে ৮৬ ফুট চওড়া একটি কেন্দ্রীয় দ্বারপথ ও দু’পাশে কোণাকুণিভাবে পেছনে সরানো আরও দুটি পথ। বিশ্বখ‍্যাত এ দরজায় কুরআনের আয়াত খোদিত আছে। এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো- এটি বাইরে থেকে দৈত্যাকৃতির হলেও ভেতরের দিকে তুলনামূলক ছোট। তাই অন্য দরজার চেয়ে এটি গঠনশৈলীর কারণে দর্শকের চোখে আলাদা জায়গা করে নিয়েছে।

 

Comments