“নাগরী” – সিলেটি ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা
ꠘꠣꠉꠞꠤ - ꠎꠤꠟꠦꠐꠤ ꠜꠣꠡꠣꠞ ꠘꠤꠎꠡ ꠛꠘꠝꠣꠟꠣ
সিলেট, বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাংশের একটি অঞ্চল। সিলেটি ভাষা সম্পর্কে অনেকের ধারণা থাকলেও সিলেটি ভাষার নিজস্ব যে অক্ষর ও লিপি আছে সে ব্যাপারে খোদ সিলেটের বেশিরভাগ মানুষই অজ্ঞাত। এই লিপির নাম “নাগরী লিপি”। শত বছরের পুরনো এই লিপির রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। শত শত সাহিত্য, দলিল ও চিটিপত্র রচনা হয়েছে এই লিপিতে। কিন্তু কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে নাগরী লিপির ব্যবহার। সিলেটের এই হারানো ঐতিহ্য কে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
নাগরী লিপির ইতিহাস
ꠘꠣꠉꠞꠤ ꠟꠤꠙꠤꠞ ꠁꠔꠤꠢꠣꠡ
ঠিক কখন নাগরী লিপির উদ্ভাবন হয় এ ব্যাপারে অনেক মতোবাদ রয়েছে। ধারণা করা হয় পনেরো শতকে হযরত শাহজালাল (রাঃ) সিলেটে আগমনের পর ধর্ম প্রচারের সুবিধার্থে নাগরী লিপির প্রচলন শুরু হয়। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত নাগরী লিপির সবচেয়ে প্রাচীন পাণ্ডুলিপি গুলাম হোসান-এর রচিত “তালিব হুছন” (১৫৪৯)। যেহেতু নাগরী লিপির সব পাণ্ডুলিপি এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি তাই অনেকের মতে এ লিপিটি আরো আগে থেকেই প্রচলিত হয়ে থাকতে পারে।
তৎকালীন মুসলমানদের মধ্যেই বেশি প্রচলিত ছিলো ভাষাটি। অপরদিকে বাংলা লিপি প্রচলিত থাকলেও অপেক্ষাকৃত সহজ হওয়ায় সাধারণ মানুষের কাছে নাগরী জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রাজকার্যে বাংলা ব্যবহৃত হলেও সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন নানা কাজে নাগরী ব্যবহৃত হতো, তাদের সুখ-দুঃখ ফুটে উঠতো নাগরী পুঁথি ও গানে।
প্রমান পাওয়া যায় যে নাগরী লিপি সিলেট অঞ্চল ছাড়িয়ে বাংলাদেশ ও বর্তমান পুর্ব ভারতের অনেক অঞ্চলে বিস্তার লাভ করেছিলো। বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি ও দলিলাদি থেকে দেখা যায় যে বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালি এবং ভারতের ত্রিপুরা, মেঘালয়া ও আসাম রাজ্য পর্যন্ত এই লিপি বিস্তার লাভ করে।
সিলেট শহরে নির্মিত “নাগরি চত্বর”
ꠍꠤꠟꠦꠐ ꠡꠢꠞꠦ ꠘꠤꠝꠤꠔ ꠘꠣꠉꠞꠤ ꠌꠔ꠆ꠛꠞ
নাগরী লিপি তার পূর্ণতা পায় যখন মৌলবী আব্দুল করিম নামক এক ব্যাক্তি সর্ব প্রথম এই লিপির অক্ষর প্রেসের মাধ্যমে প্রিন্ট করেন। তিনি ইউরোপ থাকাকালীন সময় প্রিন্টিং এর ব্যাপারে অভিজ্ঞতা লাভ করেন এবং পরবর্তীতে দেশে এসে ১৮৭০ সালে সিলেট শহরে “ইসলামিয়া প্রিন্টিং প্রেস” স্থাপন করেন, যার ফলে নাগরী লিপিতে ছাপা প্রথম বারের মতো সম্ভব হয়। পরবর্তীতে সিলেট, সুনামগঞ্জ, শিলং ও কলকাতায় এরকম আরো ৭ টি ছাপাখানা স্থাপিত হয়। জানা যায় তখন নাগরিতে একটি পত্রিকাও ছাপানো হতো।
১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ এর পুর্ব পর্যন্ত সিলেট অঞ্চলে বিদ্যালয়ে নাগরী ভাষা শেখানো হতো। কিন্তু পাকিস্থান নামক রাষ্ট্র গঠনের পর উর্দু রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয় এবং নাগরী এর প্রচলন কমতে থাকে। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইসলামিয়া প্রেস আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর এই লিপি হঠাৎ বিলুপ্তির মুখে পড়ে। যুদ্ধের পর নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা ভাষাকে মর্যাদা দেয়া হয়, অপরদিকে যথাযথ গুরুত্বের অভাবে নাগরী ইতিহাসের পাতায় স্থান নেয়।
নাগরী অক্ষর পরিচিতি
ꠘꠣꠔꠞꠤ ꠅꠇ꠆ꠞ ꠙꠞꠤꠌꠤꠔꠤ
৫ টি স্বরবর্ণ ও ২৮ টি ব্যঞ্জনবর্ণ, মোট ৩৩ টি বর্ণ নিয়ে নাগরি লিপি গঠিত। তাছাড়া ৬ টি ধ্বনি নির্দেশক চিহ্ন রয়েছে। নাগরী লিপি তে সংখ্যা নির্দেশের জন্য বাংলা সংখ্যা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যুক্ত অক্ষর অনেক কম ব্যবহার এবং বর্ণ সংখ্যা কম হওয়ার ফলে নাগরী লিপি বাংলার চাইতে তুলনামূলক সহজ।
স্বরবর্ণ
ꠡꠞ ꠛꠞꠘꠧ
আ=ꠀ , ই=ꠁ , উ=ꠃ , এ=ꠄ , অ/ও=ꠅ ,
ব্যঞ্জনবর্ণ
ꠛꠦꠘꠎꠘ ꠛꠞꠘꠧ
ক=ꠇ , খ=ꠈ , গ=ꠉ , ঘ=ꠉ , চ=ꠌ , ছ=ꠍ , জ=ꠎ , ঝ=ꠏ , ট=ꠐ , ঠ=ꠑ , ড=ꠒ , ঢ=ꠓ , ত=ꠔ , থ=ꠕ , দ=ꠖ , ধ=ꠗ , প=ꠙ , ফ=ꠚ , ব=ꠛ , ভ=ꠜ , ম=ꠝ , র=ꠞ , ল=ꠟ , শ=ꠡ , হ=ꠢ , ড়=ꠠ , ং= ꠋ,

image
  • Like
  • Love
  • HaHa
  • WoW
  • Sad
  • Angry