শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি অপসারণের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে বাংলাদেশকে কৃষি, মৎস্য, বনজ, শিল্প, নৌ পরিবহন, পানি সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হতে হয়। প্রত্যক্ষ ভাবে বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়; যদি পরোক্ষ হিসাব করা হয়, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হবে। প্রফেসর এম, আই চৌধুরী এবংসৈয়দ সফিউল্লাহ জাতিসংঘ পরিবেশ অধিদপ্তর ও হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘গ্লোবাল কার্বন প্রবাহ’ গবেষণা প্রকল্পে বিভিন্ন গুরত্বপুরন তথ্য উঠে আসে । ৮ বছরের সমীক্ষার ফলাফল সংক্ষেপে নিম্নোরূপ :
-পদ্মা নদী দিয়ে পলিপ্রবাহ প্রায় ২০% কমে গেছে (১৯৬০ সালের তুলনায়)।
-কার্বন প্রবাহ কমেছে ৩০%।
-পলিপ্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে জমির উর্বরা শক্তি কমে যাচ্ছে।
-মিনারেল এবং নিউট্রিয়েন্ট কমে যাওয়ার ফলে নদী ও জলাভূমিতে ফাইটোপ্লাকটন উৎপাদন কমেছে ৩০%। ফাইটোপ্লাকটন হচ্ছে খাদ্য চক্রের প্রথম ধাপ। এ থেকে ক্রমান্বয়ে মাছ ও অন্যান্য জলজ জীবের উৎপাদন ঘটে। পদ্মা-ব্রক্ষপুত্রের সঙ্গমস্থল আরিচাঘাটে সমীক্ষা থেকে যে ফিশ ক্যালেন্ডার তৈরী করা হয়েছে তাতে দেখা যায় ৩৫ বছর আগের তুলনায় বর্তমান মৎস্য উৎপাদন মাত্র ২৫%। ইলিশ মাছ এখানে পাওয়া যায় না বল্লেই চলে। ইলিশ মাছ স্যাড গোত্রীয় মাছ। ০-৪২০ বিষ্ণুরেখার যেখানেই সমূদ্র সংলগ্ন নদী রয়েছে সেখানেই এই মাছ পাওয়া যায়। বৎসরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে এই মাছ নোনা পানি থেকে মিঠা পানিতে আসে ডিম পাড়ার জন্য। উজানে এদের আগমন বাঁধ কিম্বা ঐ ধরনের বাধার পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত সংবেদনশলীল। ফারাক্কার আগে এক সময় রাজশাহী পদ্মা অবধি ইলিশ মাছ পাওয়া যেত। এখন আরিচাতেই এ মাছ পাওয়া যায় না। ফারাক্কা বিদ্যমান থাকলে আশঙ্কা করা হয় পদ্মা এবং তার কমান্ড অঞ্চলে ইলিশ মাছ আদৌ পাওয়া যাবে না।
-জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে সমুদ্রের পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দুধারী তলোয়ারের মত কাজ করছে। একদিকে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূল অঞ্চল তলিয়ে যাওয়া আর তার সাথে যোগ হয়েছে বাংলাদেশের সমতল ভূমির ক্রমান্বয়ে দেবে যাওয়া যাকে বলা হয় সাবসিডেন্স। এর হার বছরে ৫ মি.মি.। নদীর প্লাবনের কারণে সঞ্চিত পলি সাবসিডেনসের নেতিবাচক প্রভাবকে এতকাল পুষিয়ে নিয়ে আসছিল। ফারাক্কার কারণে এমনটি আর হতে পারছে না ।
-টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর টোশিও ইসুজুকা ও আমাদের যৌথ গবেষণায় ষ্ট্রনসিয়াম আইসোটপ সমীক্ষার মাধ্যমে দেখা গেছে যে পুরো বঙ্গোপসাগর জুড়ে সময় অনুচক্রে তীব্র ফাইটোপ্লাকটন বিকাশ ঘটে। আর এর অনুঘটক হচ্ছে নদী বাহিত নিউট্রিয়েন্ট বা পুষ্টি উপাদান ও মিনারেল। ফারাক্কা বাঁধের কারণে প্রক্রিয়াটি বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে সমগ্র বঙ্গোপসাগর জুড়ে মৎস্য উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমে যেতে পারে। বঙ্গোপসাগরের মাছের উপর ভারতের বিপুল জনগোষ্ঠিও নির্ভরশীল।একই সাথে কার্বন প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার উপশম কম হবে
-প্রফেসর কেট ক্র্যান্ক (কানাডা) এর সাথে যৌথ গবেষণায় দেখা যায় যে ফারাক্কার কারণে নদী বাহিত পলির গ্রেইন সাইজ স্পেকট্রাল প্যার্টান অর্থাৎ পলি কণার সাইজ এর তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তন বাংলাদেশের মাটির ভৌত কাঠামোর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে ।
বিস্তৃত অঞ্চল মরুকরণ
পদ্মার পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের উত্তর অববাহিকায় বিশেষ করে রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ ভূগর্ভস্থ পানির প্রথম স্তর ৮-১০ ফুট জায়গা বিশেষে ১৫ ফুট নিচে নেমে গেছে। মওসুমী বৃষ্টি ও এই স্তরে রিচার্য করে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। সেচের জন্য খরার মৌসুমে এখন ভরসা দ্বিতীয় স্তর (>৩০০ ফুট)। বরেন্দ্র অঞ্চলে এই স্তরটা মোটামুটি ফসিল পানি দিয়ে পূর্ণ। ব্যাপক সেচের ফলে এই স্তর থেকে কতদিন পানি উত্তোলন করা যাবে কে জানে। পানির অভাবে মাটির আদ্রতা শুষ্ক মওসুমে ৩৫% কমে গেছে। পানি প্রবাহের এমন করুণ অবস্থা থেকে সৃষ্ট হয় মরুকরণ প্রক্রিয়া। নদীর পানি থেকে জলীয় বাষ্প সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বায়ুর আদ্রতা সৃষ্টিতে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। খরার সময় পদ্মা নিজেই যখন বিশুষ্ক মরুভূমিতে পরিণত হয় সে তখন স্থলভূমির বায়ুতে আদ্রতার যোগান কিভাবে দিবে। আদ্রতার অভাবে দিনের নিম্নতম এবং উচ্চতম তাপমাত্রার তারতম্য বৃদ্ধি পায়। ৬০ দশকে এই তারতম্য যেখানে ৫-৮ সে. ছিল এখন সেটা বৃদ্ধি পেয়ে ৮-১২ সে. এ দাঁড়িয়েছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে মরুকরণ প্রক্রিয়ার ব্যাহিক রূপ এই অঞ্চলের জনগণ ইতিমধ্যে প্রত্যক্ষ করছেন। মরুকরণের অনেক বায়ো মার্কার রয়েছে, এইগুলো হতে পারে পানি নির্ভর উদ্ভিদ এবং আরো সুক্ষ স্তরে অণুজীব। আশা করা যায় দেশের নতুন প্রজন্মের পরিবেশ বিজ্ঞানীরা জাতীয় স্বার্থে এ ব্যাপারে গবেষণায় ব্রত হবেন।
নদীর নাব্যতা ----
ফারাক্কা পরবর্তি সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গঙা নদীর (পদ্মা) প্রবাহে চরম বিপর্যয় ঘটে। প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীর নাব্যতা কমে যায়। ফলে প্রায় বাংলাদেশর বর্তমানে প্রায়ই বড় বন্যা সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বাংলাদেশের গড়াই নদী এখন সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত।
মাটির লবণাক্ততা----
ফারাক্কা বাঁধের ফলে বাংলাদেশের খুলনা অঞ্চলের মাটির লবনাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞানীরা খুলনার রুপসা নদীর পানিতে ৫৬৩.৭৫ মিলিগ্রাম/লিটার ক্লোরাইড আয়নের উপস্থিতি পেয়েছেন। তাছাড়া, মিঠা পানির সরবরাহ কমে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে লবন, ভূ-অভ্যন্তরস্থ পানিতে প্রবেশ করছে।
কৃষি----
কৃষির অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। পানির স্তর অনেক নেমে যাওয়ার দক্ষিণ অঞ্চলের জি-কে সেচ প্রকল্প মারাত্বক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সেচযন্ত্র গুলো হয়ত বন্ধ হয়ে আছে অথবা সেগুলোর উপর তার ক্ষমতার চাইতে বেশি চাপ পড়ছে। এই প্রকল্পের অন্তর্গত প্রায় ১২১,৪১০ হেক্টর জমি রয়েছে। মাটির আর্দ্রতা, লবনাক্ততা, মিঠা পানির অপ্রাপ্যতা কৃষির মারাত্বক ক্ষতি করেছে।
মৎস----
পানি অপসারণের ফলে পদ্মা ও এর শাখা-প্রশাখাগুলোর প্রবাহের ধরন, পানি প্রবাহের বেগ, মোট দ্রবীভূত পদার্থ (Total dissolved solids) এবং লবণাক্ততার পরিবর্তন ঘটেছে। এই বিষয় গুলো মাছের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গঙ্গার পানির উপর এই এলাকার প্রায় দুই শতেরও বেশি মাছের প্রজাতি ও ১৮ প্রজাতির চিংড়ী নির্ভর করে। ফারাক্কা বাঁধের জন্য মাছের সরবরাহ কমে যায় এবং কয়েক হাজার জেলে বেকার হয়ে পড়েন।
নৌ-পরিবহন-----
শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের ৩২০ কিলোমিটারের বেশি নৌপথ নৌ-চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে, কয়েক হাজার লোক বেকার হয়ে পড়ে, নৌ-পরিবহনের খরচ বেড়ে যায়।
ভূ-অভ্যন্তরে পানির স্তর----
ভূ-অভ্যন্তরের পানির স্তর বেশিরভাগ জায়গায়ই ৩ মিটারের বেশি কমে গেছে।তাছাড়া বিভিন্ন দ্রবিভুত পদার্থের , ক্লোরাইড, সালফেট ইত্যাদির ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার কারণেও পানির স্তর কমছে। এর প্রভাব পড়ছে কৃষি, শিল্প, পানি সরবরাহ ইত্যাদির উপর। মানুষের বাধ্য হয়ে ১২০০ মিলিগ্রাম/লিটার দ্রবিভুত পদার্থ সম্পন্ন পানি পান করছে। যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO = World health organization) ৫০০ মিলিগ্রাম/লিটারের কম দ্রবীভূত পদার্থ সম্পন্ন পানিকেই মানুষের পান করার জন্য উপযুক্ত বলে ঘোষণা করেছে।
ভারতের ক্ষতি-----
একচল্লিশ বছর আগে গঙ্গার উপর যখন ফারাক্কা বাঁধ চালু করা হয়, তার একটা প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জলপ্রবাহের একটা অংশকে হুগলী নদীতে চালিত করে কলকাতা বন্দরকে পুনরুজ্জীবিত করা।সে উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল না-হলেও ফারাক্কার জেরে গঙ্গার উজানে যে পলি পড়া শুরু হয়েছে, তারে জেরে প্রতি বছরই বর্ষার মরশুমে বন্যাকবলিত হয়ে পড়ছে বিহার ও উত্তরপ্রদেশের একটা বিস্তীর্ণ অংশ।। বহুদিন ধরেই মালদহ-মুর্শিদাবাদ জেলার গঙ্গা তীরবর্তী দুর্ভোগ ও বিপর্যয়কবলিত মানুষ ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। একই সঙ্গে তারা ক্ষতিপূরণ, ভূমি ও পুনর্বাসন দাবি করে আসছে। অব্যাহত বন্যা ও নদীভাঙন প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণেরও তারা দাবি জানিয়ে আসছে। বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গের জন্যও ফারাক্কা বাঁধ বড় রকমের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, পার্শ্ববর্তী বিহারও ফারাক্কা বাঁধের কারণে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। সেখানে চলমান বন্যায় ১০ লাখের বেশি মানুষ ও ২ লাখ মানুষের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিহার রাজ্য সরকারের দাবি, ফারাক্কা বাঁধের কারণেই এই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং প্রায় প্রতিবছরই রাজ্য বন্যা ও নদীভাঙনের শিকার হচ্ছে।
[ সূত্র-উইকিপিডিয়াঃ

  • Beğen
  • Aşk
  • HaHa
  • Vay
  • Üzgün
  • kızgın