ধোঁয়া ধোঁয়া ধোঁয়া, টাকা টাকা টাকা


কষ্ট করে ১ মিনিট সময় বের করে আর্টিকেলটি পড়বেন। আশা করি ভালো লাগবে। আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট হবে না।।।

মশা নিধনের যুদ্ধে যথেষ্ট ধোঁয়া উৎপাদিত হলেও মশা মরেছে কম। মশা নিধন একটা জনস্বাস্থ্যের ব্যাপার, নগরশৌচের ব্যাপার। এর সঙ্গে যুদ্ধের কী সম্পর্ক? আমাদের নেতা-নেত্রী-সেলিব্রিটিরা একেকজন যেন সেনানায়ক। তাঁদের অভিধান যুদ্ধবাদী পরিভাষায় টইটম্বুর। কত রকমের যুদ্ধ তাঁদের করতে হয়, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এত সব যুদ্ধের মধ্যে মানুষ মরেছে কেবল মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে। মশার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ব্যর্থতায় মানুষ মরছে বটে, মশকশিবিরে ক্ষয়ক্ষতি এখন পর্যন্ত সামান্যই।

এত যুদ্ধ, এত ধোঁয়া ছিটানোর পর এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এডিস মশা পানিতেও ডিম পাড়ে না, ধোঁয়া ছড়িয়েও কাজ হয় না। কারণ, তা ডিম পাড়ে শুকনা পাত্রের কোনায়। এবং বন্যা বা পানি পেলে ডিম ফুটে বের হয়। দ্বিতীয়ত, মশা গৃহহীনদের মতো রাস্তাঘাটে ঘুমায় না। ঘুমায় আমাদের বাড়ির আর্দ্র ও অন্ধকার জায়গায়। খাটের নিচে, সোফার নিচে ইত্যাকার স্থানে। তাহলে আমাদের মশক সেনাপতিরা এত দিন যে যুদ্ধ লড়লেন কী চিন্তা করে? প্রধানমন্ত্রীও বিবিসির সাক্ষাৎকারে বললেন যে, নগর কর্তৃপক্ষের দোষ নেই! 

মশার বিরুদ্ধে যুদ্ধের আর্টিলারি বাহিনীর প্রধান কামান হলো ফগিং মেশিন। ওই যে যন্ত্রের কামানের মতো নল দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া বেরোয়, সেটার কথা হচ্ছে। এর বাংলা হতে পারে কুয়াশা মেশিন, অর্থাৎ এই মেশিন কুয়াশা সৃষ্টি করে। মশা নিধনে এই মেশিন যথেষ্ট কুয়াশা তৈরি করতে পারলেও ডেঙ্গু মোটেই কমেনি। মনের দুঃখে গাইতে ইচ্ছা করছে কিশোর কুমারের সেই গানটা:

ধোঁয়া ধোঁয়া ধোঁয়া, ধোঁয়া ধোঁয়া ধোঁয়া
পারি না সইতে, না পারি কইতে
তুমি কি কুয়াশা?

ফগিং মেশিনের ধোঁয়ায় ডেঙ্গু দমনে সরকারি ব্যর্থতার ছবিটা কি কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে?

ভিডিওতে দেখা গেল, বিভিন্ন ছাত্রাবাসের গণরুমের অবারিত শয্যারাশিতে চিত-কাত-উপুড় হয়ে থাকা ছাত্রদের ওপর ফগিং মেশিন থেকে বিস্তর ধোঁয়া দেওয়া চলছে। আরও দেখলাম: হজ ক্যাম্পে প্রবীণ ব্যক্তিরা বিমানযাত্রার অপেক্ষায় শুয়ে-বসে আছেন। শত শত বিছানা, শত শত মানুষ। এর মধ্যে হাড্ডি খিজির টাইপ এক পৌরকর্মী তাঁদের ওপর ফগিং মেশিন চালিয়ে দিলেন। চালানোর স্টাইলটা অনেকটা হলিউডি অ্যাকশন হিরো শোয়ার্জেনেগারের মেশিন গান চালানোর মতো। আরও দেখেছি, খোলা পিকআপে চড়ে পুরো সামরিক কায়দায় দুজন নর–নারী ফিল্মি স্টাইলে দুই পাশে ফগিং মেশিন বাগিয়ে বীরের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের ওই ভঙ্গিটা মশকবিরোধী যুদ্ধের বীরদের ভাস্কর্য নির্মাণের একদম উপযুক্ত। ঢাকা শহরে অজস্র বিকট ভাস্কর্য নির্মাণের কীর্তিমান শিল্পীকে দিয়ে ফগিং মেশিনের আর্টিলারি বাহিনীর জেনারেলদের ভাস্কর্য বানানোর দরপত্র আহ্বানের এখনই সময়।

এত সব ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে গেল আসল কথাটা। মশা মারার জন্য যে কীটনাশক বছরের পর বছর ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে পরিবেশদূষণ হলেও মশার কোনো ক্ষতি হয় না। ডেঙ্গু মশার জন্য দায়ী এডিস মশা তো আরও দুর্ধর্ষ। ফগিং মেশিন বা নায়ক-নায়িকাশোভিত ঝাড়ুবাহিনীর নাটুকে কাজকারবার দেখে তারা হেসে কুটিকুটি তো হয়ই, মানুষের নির্বুদ্ধিতা দেখে আরও নির্ভীকও হয়। মশারা হয়তো জেনে গেছে, ভূত তাড়ানোর সরষেতেই গলদ। মশা মারতে ঝাড়ুর কী ব্যবহার, কেউ কি বলতে পারেন? ঝাড়ুতে বড়জোর ধুলা ওড়ে। এরও কাজ কি চোখে ধুলা দিয়ে যাওয়া? মাথায় কত প্রশ্ন আসে, কিন্তু উত্তর মেলে না।

খবরে প্রকাশ, সিটি করপোরেশনের কেনা মশার ওষুধে মশার ক্ষতি না হলেও লাভবান হয়েছে কোম্পানি ও কর্মকর্তারা। এসব দেখে ‘এবার মশা বাড়বে’—স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের এমন হুঁশিয়ারিও চেপে যাওয়া হয়েছে। ‘২০১৮ সাল জাতীয় নির্বাচনের বছর ছিল বলে ওষুধ অকার্যকর হওয়ার বিষয়টি চেপে যেতে চেয়েছিলেন সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সতর্কবার্তাও সিটি করপোরেশন কানে নেয়নি। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এই মশার ওষুধ কেনাকাটায় রয়েছে নানা অসংগতি।’ (প্রথম আলো, ৩১ জুলাই, ২০১৯)

খবরে আরও বলা হয়েছে, ‘তবে এরই মধ্যে ওষুধ সরবরাহকারীরা লাভ যা করার তা করে নিয়েছেন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উত্তর সিটি করপোরেশন মশকনিধনে ১৪ কোটি টাকার ওষুধ কিনেছে। আর দক্ষিণ সিটি ওষুধ কিনতে ব্যয় করেছে ১৭ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। অথচ এই দুই সিটি করপোরেশন মিলে দেশবাসীকে অশেষ দুর্গতিতে ফেলেছে। ...একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছিলেন, এটা নির্বাচনের বছর। ওষুধ অকার্যকর হওয়ার কথা যেন চারদেয়ালের বাইরে না যায়।’ (ওই)

এই হলো অবস্থা। এবং এই অবস্থাটা শুধু না, আরও অনেক অবস্থাই ঢেকে গেছে ফগিং মেশিনের ধূম্রজালে। ঢেকে গেছে অবিরত শিশু ধর্ষণ, রিফাত হত্যাকাণ্ড ইস্যু, ঢেকে গেছে বন্যা মোকাবিলার ব্যর্থতা, ঢেকে গেছে গ্যাসের দাম, ব্যাংকের অর্থ তছরুপ, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ধস, শেয়ারবাজার থেকে ১৫ দিনে উধাও হওয়া ২৭ হাজার কোটি টাকার খোঁজ। ঢেকে গেছে রিফাত হত্যাকাণ্ডের পলাতক আসামি, তাঁদের গডফাদার স্থানীয় এমপি ও তাঁর পুত্র এবং প্রশ্নবিদ্ধ কায়দায় রিফাতের স্ত্রী মিন্নির গ্রেপ্তার ও বারংবার রিমান্ডের প্রশ্ন। এর মধ্যে ৪ আগস্ট খুলনায় থানার মধ্যে এক নারীকে পুলিশ সদস্যদের দ্বারা গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট প্রতিবছর স্টেট অব দ্য নেশন নামের বক্তৃতায় জাতির অবস্থার কথা জানান। ডেঙ্গু এসে আমাদের জাতির দুরবস্থার অন্যান্য চিত্র যে ঢেকে দিতে পেরেছে, তাতে লাভবানপক্ষরা মশাকে ধন্যবাদ দিতে পারে। তারা চাইতেও পারে যাতে ইস্যুটা দীর্ঘদিন থাকে এবং ফেসবুকনির্ভরদের মগজ অধিকার করে রাখে।

অক্ষমতার ধোঁয়া উড়িয়ে ব্যবসা করা যায়, তবে যে মশার ওষুধ ছিটানো হয়ইনি, হলেও যাতে কাজ হয়নি, তার নামেও কোটি কোটি টাকা ব্যয় দেখানো যায়।

এই হলো ‘স্টেট অব দ্য নেশন’—জাতির অবস্থা, দেশের অবস্থা। সব দেখেশুনে কিশোর কুমারের গাওয়া গানটা আবারও মনের মধ্যে এডিস মশার মতো হুল ফোটায়: না পারি সইতে, না পারি কইতে। তুমি কি কুয়াশা?

বর্তমান ধোঁয়াটে, ভবিষ্যৎ কুয়াশাচ্ছন্ন।

430 Просмотры

Комментарии