রাসূল ﷺ আমাদের ভালোবাসতেন, ভাবতেন আমাদের নিয়ে, কাঁদতেন আমাদের বিরহে; আমাদেরও কি উচিত নয় তাঁকে ভালোবাসা!


রাসূল ﷺ আমাদের ভালোবাসতেন, ভাবতেন আমাদের নিয়ে, কাঁদতেন আমাদের বিরহে; আমাদেরও কি উচিত নয় তাঁকে ভালোবাসা!

.

আহ! আমাদের নিয়ে কতই না সুন্দর কথা বলেছেন আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম:
হযরত আবূ হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ'লা আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: 'আমার উম্মতের ভেতরে আমাকে তারাই বেশি ভালোবাসবে- যারা আমার (ওফাতের) পরে আসবে! তাদের কেউ এমনও আশা করবে যে, আমাকে দেখলে, আমার জন্যে সে তার পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদও কুরবান করে দিতো।' (মিশকাত: ৬০২৪ ও মুসলিম শরীফাঈন)।

আহ! তিনি কতই না ভাবতেন আমাদের নিয়ে:
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফরমালেন: 'আমার কাছে ঈমানের দিক দিয়ে ঐ সৃষ্টি বেশি বিস্ময়কর- যে জাতি আমার পরে আসবে এবং তারা (আমাকে না দেখেও আমার উপর ঈমান এনে) আসমানী কিতাব (আল-কুরআন) পেয়ে তাতে বর্ণিত বিধিবিধানের প্রতি ঈমান আনবে।' (মিশকাত: ৬০২৮ ও ইমাম বায়হাকীর দালায়িলুন নবুওয়াত)।

উম্মতের জন্য তাঁর কি অপরিসীম দরদমাখা দুআ:
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা এক দিন আল্লাহর রাসূল ﷺ এর সাথে ছিলেন। রাসূল ﷺ কে বেশ উৎফুল্ল দেখে হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার জন্য আল্লাহ তাআ'লার কাছে দুআ করুন।’

রাসূল ﷺ উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহার জন্য দুআ করলেন। 'হে আল্লাহ! আয়েশাকে মাফ করে দিন। তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দিন, তার আগামীর গুনাহ মাফ করে দিন, তার গোপনে করা গুনাহ মাফ করে দিন, তার প্রকাশ্যে করা গুনাহও মাফ করে দিন।'

রাসূল ﷺ এর দুআর এমন সুন্দর বাক্য শ্রবনে হযরত উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা হাসলেন। রাসূল ﷺ আয়েশারাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার এই দুআ কি তোমাকে আনন্দিত করেছে?’

হযরত উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা বললেন, ‘কি করে এমন দুআ কাউকে সন্তুষ্ট না করে পারে!’

প্রিয় নবীজী ﷺ হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহাকে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি আমার উম্মতের জন্য আমার প্রতি নামাজে এই একই দুআ করি।’

যে দুআ রাসূল ﷺ তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য করেছেন, সেই একই দুআ' প্রতি নামাজে তিনি তাঁর উম্মতের জন্য করেছেন, আপনার জন্য, আমার জন্য করেছেন। তিনিই আমাদের রাসূল ﷺ। প্রিয়তম রাসূল ﷺ ।

আমাদের জন্য কাঁদতেন তিনি: 
কোনো একদিন। পথ চলছিলেন আল্লাহর রাসূল ﷺ। কি এক চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো তাঁর চেহারা মোবারকে। হঠাত কেঁদে উঠলেন তিনি। সাথে থাকা সাহাবা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুমগন কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘আমি আমার ভাইদের জন্য কাঁদছি।’ 

সাহাবাগন বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমরা কি আপনার ভাই নই?’

রাসূল ﷺ বললেন, ‘তোমরা তো আমার সাথী। আমার ভাই হল তারা, যারা আমার পরে আসবে, আর আমাকে না দেখেই আমার উপর ঈমান আনবে।'

এমন দরদীকে ভালোবাসা কি আমাদের দায়িত্ব নয়?
প্রিয়তম রাসূল ﷺ আমার জন্য আপনার জন্য কেঁদেছেন। আমাদের মনে করে নিরবে কেঁদেছেন। চোখের অশ্রু ঝড়িয়েছেন। আমাদেরকে ভেবে ব্যাকুল হয়েছেন। আমাদের না দেখেও কল্পনায় আমাদের দেখার চেষ্টা করেছেন আমাদের পৃথিবীতে আগমনের পূর্বেই। আজ আমরা কতোটুকু অনুভব করি প্রিয় নবীজীকে? ক'দিন তাঁর স্মরণে আমাদের চোখ অশ্রু ঝড়িয়েছে? তাঁর জন্য কাঁদতে পেরেছি কি কোনো দিন? ফেলতে পেরেছি চোখের দু'ফোটা তাজা তপ্ত অশ্রু? উম্মতের প্রতি এমনই দয়ালু ছিলেন তিনি যে, আমাদের জন্য প্রতি নামাজে তাঁর দুআর হাত আকাশের দিকে উঠতো। তিনি দুআ করতেন। উম্মতের নাজাত কামনায় বেকারার ব্যাকুল অস্থির হতেন। কান্নায় বুক ভাসাতেন। ক্ষুধা তৃষ্ণার অপরিসীম কষ্ট সহ্য করে পেটে পাথর বাঁধতেন। অবিশ্বাসীদের হাজারো অত্যাচার জুলূম সহ্য করে যেতেন। অন্যায়ের প্রতিশোধ অন্যায় দিয়ে নিতেন না। নির্বোধদের দেয়া শত আঘাত অকাতরে সয়ে যেতেন। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়েও তাদের ধ্বংসের দুআ করতেন না। বরং দুআ করতেন তাদের পথপ্রাপ্তির জন্য। তাদের হেদায়েতের জন্য। তাদের দুনিয়া আখিরাতের জীবন আলোকিত করার প্রত্যয়ে। প্রিয়তম সেই রাসূলের প্রতি আমাদের হৃদয়ের ভালোবাসা কতটুকু! আমরা তাকে কতটুকু ভালোবাসতে পেরেছি! তাঁর স্মরণে আমরা দিনে কতবার দরুদ পড়ি? তাঁকে ভালোবেসে, তাঁর আচরিত সুন্নাহগুলোকে ভালোবেসে নিজেদের জীবনে তা কতটুকু ধারণ করতে পেরেছি আমরা?

খেজুর বৃক্ষও যার বিরহে কাঁদে:
হিজরত করে মদিনায় চলে এলেন রাসূলে পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মুসলমানদের ইবাদতের উদ্দেশ্যে মদিনার কেন্দ্রস্থলে আবু আইয়ূব আনসারি রাদিআল্লাহু তাআ'লার বাড়ি সংলগ্ন স্থানে নির্মান করলেন মসজিদে নববী। খেজুর পাতার ছাউনি আর খেজুর গাছের কান্ড দিয়ে তৈরি মসজিদে নববীতে তখনও তৈরি হয়নি কোনো মিম্বার। আল্লাহর রাসূল ﷺ খুতবাহ দিতেন একটি গাছে হেলান দিয়ে। একপর্যায়ে মিম্বার তৈরি হল। রাসূল ﷺ মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুৎবা দিচ্ছিলেন। উপস্থিত সাহাবাগন আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন, তারা স্পষ্ট শুনতে পেলেন, পরিত্যক্ত সেই খেজুর বৃক্ষের খুটি থেকে শিশুর মত অঝোরে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। প্রিয়তম রাসূলের বিরহে খেজুর বৃক্ষের কান্নার সেই শব্দ ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা মসজিদে নববীতে। সহিহ হাদিসের ভাষ্যে প্রমান, স্বয়ং রাসূলে পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই খুটিটিতে হাত বুলিয়ে দেয়ার পরই তার কান্না বন্ধ হয়। আহ! একটি গাছও রাসূল ﷺ এর বিরহে কেঁদেছে। তাঁর বিচ্ছেদে কান্নার ঢেউ খেলেছে গাছের বুকেও। 

গোটা মদিনায় কান্নার রোল:
আল্লাহর রাসূল ﷺ এর ইনতিকালের পর অন্যান্য সাহাবীদের মত শোকে পাথর হয়ে যান হযরত বিলাল রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ'লা আনহুও। তিনি প্রিয়তম রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তিরোধানে এতটাই শোকাহত হয়ে পড়েন যে, তিনি আর আযান দিতে পারলেন না। যে মদিনায় ছুটে এসেছিলেন আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সহচর হয়ে। দিনরাত পেরিয়ে যেত যার নূরানী চেহারা দেখে। আজ তিনি নেই। যে মদিনায় তিনি নেই, সেখানে থেকে আর কি হবে- এমনই মনোভাব থেকে একদিন চলে গেলেন মদিনা ছেড়ে। 

অনেক দিন পরে। রাসূল ﷺ কে স্বপ্নে দেখলেন তিনি। রাসূল ﷺ হযরত বিলাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে বলছেন, 'বিলাল, এতদিনেও কি তোমার সময় হয়নি আমার রওজায় আসার?'

প্রায় ছয় মাস পরে বিলাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ফিরে এলেন প্রিয় মদিনায়। তপ্ত প্রাণে ছুটে গেলেন রাসূলের রওজাপানে। সালাত ও সালাম জানালেন প্রিয়তম রাসূলে পাককে।

মদিনাবাসীগন হযরত বিলাল রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর সেই দরদমাখা আযান শুনতে পান না কত দিন! তারা অনুরোধ করলেন। হযরত বিলাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যেন একটিবার আযান দেন। কিন্তু তিনি মনঃস্থির করেছেন, রাসূলের জন্য যে আযান দিতেন তা আর কোনদিন কারো জন্য দিবেন না। শেষে হযরত উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর অনুরোধে হযরত বিলাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আযান দেওয়া শুরু করলেন। সেই আযান, সেই মধুময় সময়, সেই স্মৃতি, রাসূলুল্লাহর পুরনোসব স্মৃতি- সব যেন একসাথে ভেসে আসা শুরু করল। কিছুক্ষণের জন্য মদিনার লোকেরা মনে করলেন, রাসূল ﷺ বুঝি আবার ফিরে এসেছেন। মদিনার ঘরগুলো থেকে সবাই বেরিয়ে আসা শুরু করলেন। হযরত বিলাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যখন আযানে 'আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ'র স্থানে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন, পুরো মদিনাজুড়ে কান্নার হুহু শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ ছিল না! আহ! হুব্বে রাসূল কেমন ছিল তাদের! আমাদের ভেতরে সেই রাসূল প্রেম কি আছে? থাকলেও, তা কতটুকু আছে? 

তিনটি কাজ আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ:
হযরত আব্দুর রহমান ইবনে ’আলা হাদ্বরামী রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ'লা আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন: 'এ উম্মতের শেষ পর্যায়ে এমন এক সম্প্রদায় আসবে যাদের নেক আমলের সওয়াব তাদের প্রথম যুগের লোকদের (সাহাবায়ে কেরামের) সমতুল্য হবে, তারা মানুষজনকে সৎ কাজের আদেশ করবে ও অসৎ কাজ করতে নিষেধ করবে এবং ফিতনাবাজদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে।' (মিশকাত: ৬০২৯ ও ইমাম বায়হাকীঃ দালায়িলুন নবুওয়াত)

রাসূলপ্রেমই মুক্তির পথ:
প্রিয় নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনগাঁথা শুনে আমাদের হৃদয়ে কি তাঁর ভালোবাসা জাগ্রত হয়? আমরা কি সত্যি পেরেছি তাকে ভালোবাসতে? তাঁর ভালোবাসা, তাঁর সুন্নাতের প্রতি ভালোবাসা আমাদের মন ও মননে কি বাসা বাধতে পেরেছে? তাকে ভাবলে, তাঁর অগনিত স্মৃতির পাতা উল্টালে আমাদের চোখ কি অশ্রুসজল হয়? তাঁর মুহাব্বতে আমাদের অন্তর কাঁদে? হৃদয় কাঁদে? আর সবার মুহাব্বতের উপরে তাঁর মুহাব্বতকে আমরা প্রাধান্য দিতে পেরেছি কি? তাঁর স্মরণ আমাদের হৃদয়ে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দেয় কি? তাঁর প্রতিটি সুন্নাত পালন আমাদের অন্তরে প্রশান্তির সুবাতাস বইয়ে দেয় কি? তাঁর রেখে যাওয়া অনুপম আদর্শকে আমাদের চলার পথের পাথেয় বানিয়ে নিয়েছি কি? প্রিয় বন্ধু, এটাইতো মুক্তির পথ। এটাইতো মহান রব্বুল আলামীনকে চেনা, জানা এবং ভালোবাসারও প্রকৃত পথ। এ-ইতো সাফল্যের মহাসড়ক! আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার ক্ষমা এবং জান্নাতের দ্বারে গিয়ে মিশে গেছে যে পথের শেষ গন্তব্য! 

قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
'বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহ ও তোমাদিগকে ভালবাসেন এবং তোমাদিগকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু।'
Say: "If ye do love Allah, Follow me: Allah will love you and forgive you your sins: For Allah is Oft-Forgiving, Most Merciful."

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা আমাদের প্রত্যেককে প্রিয় নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যিকারের অনুসারী হওয়ার তাওফিক দান করুন। কথা কাজে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একমাত্র তাঁর আদর্শকে অনুসরণ এবং অনুকরণের কিসমত নসিব করুন।

859 Views

Comments