একটু চুপ থেকে, সামান্য ধৈর্য্যধারণ করে যদি সংসারে শান্তি পাওয়া যায়, তাহলে কেন নয়...!!!


ছবিঃ ইন্টারনেট

.

হযরত উমার রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর জামানা। তখন তিনি খলিফাতুল মুমিনীন। অর্ধ পৃথিবীর খলিফা। শাসক। প্রেসিডেন্ট। 

অর্ধ পৃথিবীর খলিফা হলেও তিনি কিন্তু আমাদের সময়কার শাসকদের মত ছিলেন না। এতবড় বিশাল বিস্তীর্ন অঞ্চলের শাসনকর্তার আসনে সমাসীন থাকা সত্বেও এক ফোটা অহংকার তাকে স্পর্শ করতে পারেনি কখনও। প্রজা সাধারণের সুখ-দু:খের কথা স্বয়ং নিজেই শুনতেন। সমাধানও করতেন সাধ্যমত। কারও বাধা ছিল না তার দরবারে যেতে। তো একদিনের ঘটনা, এক ব্যক্তি নিজের স্ত্রীর উগ্রমেজাজী কথায় খুবই আহতবোধ করলেন। নিজের আত্মসম্মানে আঘাত লাগায় একপর্যায়ে অতিষ্ট হয়ে খলিফা উমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর কাছে এলেন স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করার উদ্দেশ্যে।

খলিফাতুল মুমিনীনের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন আগন্তুক ব্যক্তি। হঠাতই তিনি উমার রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর ঘরের ভেতর থেকে মহিলার রাগত কন্ঠস্বর শুনতে পান। তিনি অনুমান করলেন, অন্য কোনো দম্পতির কথোপকথন হয়তো এটা। কিন্তু না, অল্পক্ষনের ভেতরেই ভুল ভেঙে গেল তার। রাগান্বিত স্বরে যারা কথা বলছিলেন তারা স্বয়ং খলিফা দম্পতি। খলিফার সাথে কথা বলছেন তার স্ত্রী। স্ত্রীর বিরুদ্ধে বিচারপ্রার্থী আগন্তুক ব্যক্তি রীতিমত হতবাক। একরাশ হতাশা তাকে ঘিরে ধরলো। ভাবলেন, কার কাছে বিচার দেব? তিনি নিজেই তো আমার মত বউয়ের হাতে নাকাল। মনের দু:খ মনে চেপে খলিফাকে কিছু না বলে সোজা ফিরে চললেন বাড়ির দিকে।

কয়েক পা যেতেই পেছনে তাকিয়ে দেখলেন, ঘরের দরজা খুলে বাইরে এলেন খলিফা উমার রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু। ঐ ব্যক্তিকে কিছু না বলে চুপি চুপি চলে যেতে দেখে ডাক দিলেন। কাছে ডেকে এনে জানতে চাইলেন, 'কেনো তিনি এসেছিলেন আর কেনোই বা কিছু না বলেই চলে যাচ্ছেন এমনভাবে!'

আগন্তুক নিতান্ত অনিচ্ছায় বললেন, 'আমিরুল মুমিনীন, আমি এসেছিলাম আমার স্ত্রীর উগ্র মেজাজের কথাবার্তার বিষয়ে আপনার নিকট অভিযোগ জানাতে কিন্তু এসে অবাক হয়ে শুনলাম আপনার স্ত্রী আপনাকে আরো বেশী কথা শোনাচ্ছেন। তাই কি আর করব, আপনি নিজেই যেহেতু আমার মত একজন ভুক্তভূগী, তাই অভিযোগ করে লাভ হবে না ভেবে ফিরে যাচ্ছিলাম।' 

একটু থেমে ভদ্রলোক আবার বলতে শুরু করলেন- 'আচ্ছা, আমিরুল মুমিনীন, একটি কথা বুঝে আসছে না, বড় বড় বীর পুরুষরা পর্যন্ত যেখানে আপনাকে বাঘের মত ভয় পায়, বাঘে-মহিষে যে উমারের নাম শুনলে এক ঘাটে পানি পান করে, রোম এবং পারস্য সম্রাটরা পর্যন্ত যেখানে আপনার ভয়ে থরথর কম্পমান- সেখানে একজন মহিলা হয়ে আপনার ঘরের স্ত্রী আপনাকে কি করে কথা শোনানোর সাহস পায়?'

এবার হযরত উমার রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু অনন্য সুন্দর একটি উত্তর দিবেন। যে উত্তরটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এই উত্তরটি না জানা থাকার ফলে ঘরে ঘরে আজ কলহ-বিবাদ। স্বামী-স্ত্রী দ্বন্ধ। ঝগড়াঝাটি-মারামারি। কলহ-বিভেদ। আত্মীয়তার সম্পর্ক পর্যন্ত ছিন্ন হয়ে যায় যে একটিমাত্র উত্তর না জানার কারণে। আমিরুল মুমিনীন বলেন, 'ভাই ঐ মহিলা (আমার স্ত্রী) -র অনেক হক্ব রয়েছে যা আমি আদায় করতে পারিনি। তাছাড়া এই মহিলা আমার রান্না করেন। ঘরবাড়ি, কাপড়-চোপর পরিস্কার করেন। সন্তানদের প্রতিপালন করেন। এমনি সংসারের আরও অনেক অনেক কাজ তিনি প্রতিনিয়ত করে থাকেন, মূলত: যা করতে তিনি বাধ্য নন।'

'ভাই, এসব কাজ করে তিনি আমার প্রতি ইহসান করে থাকেন। অতএব তিনি আমার নিকট একজন পাওনাদার। আর জানেনই তো, আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ হচ্ছে- পাওনাদারের দু' কথা বেশী বলার অধিকার রয়েছে।' -বলে চলেছেন আমিরুল মুমিনীন। 

বিচারপ্রার্থী আগন্তুক বললেন, 'হায় হায়! আমার স্ত্রীও তো ঘর গৃহস্থালীর এসব যাবতীয় কাজ করে থাকে এবং আমিও তো তার অনেক হক্বই আদায় করতে পারি না। তাহলে তিনিও তো আমার নিকট একজন উত্তম পাওনাদারের মর্যাদা পেতে পারেন।'

খলিফা এবার হাসি মুখে বললেন, 'তাহলে ভাই, একটু সহ্য করুন।'

আমিরুল মুমিনীন সাইয়্যিদিনা উমার রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর জীবনে সংঘটিত ছোট্ট এই উদাহরণটি চিন্তা করলেই বোঝা যায়, নারীদের প্রতি কেমন ছিল ইসলামের সূর্যসন্তানদের অনুভূতি! কতটা আন্তরিকতা দিয়ে তারা নারীকে বুঝার চেষ্টা করতেন! ইসলাম কতটুকু সম্মান দিয়েছে নারীদের! মায়ের জাতিকে!

আজ ঘরে ঘরে অশান্তির ঝঞ্ঝাবায়ু বয়ে যায় যেন। স্বামী এক কথা বললে স্ত্রী তিন কথা বলে বসেন। স্ত্রী একটি কটু কথা বললে স্বামী ছয়টি গালি ছুঁড়ে দেন। কথায় কথায় তালাক। উঠতে বসতে গালিগালাজ। মারামারি রক্তারক্তি পর্যন্ত অহরহ ঘটতে দেখা যায়। পরস্পর পরস্পরের প্রতি সহনশীলতার অভাব, আন্তরিকতার অভাব, ধর্মীয় শিক্ষার ঘাটতিসহ নানান ধরণের ব্যাধি আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। আজ সমাজ-সংসারের সুখ-শান্তি নষ্ট হওয়ার জন্য একতরফাভাবে নারীদের উপর দোষ চাপাতেও দেখা যায় কিছু মানুষকে। তাদের বলি, শুধুমাত্র নারীদের প্রতি দোষ না চাপিয়ে, নিজের দুর্বল দিকগুলোও ভাবুন। নারীদের অধিকার আপনি কতটুকু দিচ্ছেন আর বিপরীতে তাদের নিকট থেকে কতটুকু বুঝে নিচ্ছেন তার হিসাব মেলালেই এই রুক্ষ্ম আচরণে পরিবর্তন এসে যেতো। আসুন, মায়ের জাতিকে তাদের প্রাপ্য সম্মান দিয়ে তাদের প্রতি সহযোগিতা আর সহমর্মিতার মনোভাব পোষণ করি। এই মনোভাবই কেবল উপহার দিতে পারে হাস্যোজ্জ্বল আলোকিত একটি সমাজ-সংসার। 

স্ত্রী তো আপনার গোস্ত কেটে নেননি! তিনি তো আপনাকে প্রহারও করেননি! তাহলে? তাহলে মাঝে-সাজে একটু আধটু রেগে গেলে আপনিও চটে যান কেন? আরে ভাই, শান্তি কে না চায়! আসুন না, উমার রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর চমকপ্রদ শিক্ষা অনুসরণ করে একটু চুপ থেকে, সামান্য ধৈর্য্যধারণ করে যদি সংসারে শান্তি পাওয়া যায়, তাহলে কেন নয়...!!!

Comments