রাজধানীর সড়কে মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে যুগান্তকারী চিন্তা


ছবিঃ ইন্টারনেট

.

আমাদের দেশে মানুষ হাসিতামাশা জিনিসটা সহজভাবে নিতে পারেনা এটা বেশ প্রমাণিত সত্য। হালকা রসিকতামূলক লেখার জন্য বহু সাহিত্যিককেই বহুবার দা-চাপাতি পার্টির (দ্বীনের সৈনিকদল) রোষানলে পড়তে হয়েছে। এককালে প্রথমআলোর জনপ্রিয় আলপিন নামক বিনোদন পত্রিকাটি নিয়ে যেরকম দাপাদাপি হয়েছিলো, সেটা অনেকেরই মনে আছে হয়তো। শেষ পর্যন্ত নামই বদলে দিতে হয়েছিলো সেটার। নতুন নাম দেয়া হয়েছিলো রস+আলো। সম্ভবত রস যোগাতে না পারার কারণে বর্তমানে সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের লোকের জোকস পড়বার সময় নেই। তারা আন্দোলনের খবর চায়, ডাকসু নির্বাচনের খবর চায়, সড়কে মৃত্যুর খবর চায়, বিভিন্ন জেলায় প্রতিদিন ধর্ষণের বিস্তারিত বর্ণনাসমেত খবর চায়, রাজনীতিবিদদের দূর্নীতির পর্দা ফাঁস করা আলোচনা চায়, সরকারী দপ্তরে অনিয়ম-ঘুষের রগরগে বর্ণনা চায়। এসবের মাঝে রঙ্গতামাশার কোনও স্থান নেই। "ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়" অবস্থা যাকে বলে, এখন সিরিয়াস সময় সবার, কৌতুক-তামাশা করা নিষিদ্ধ। কয়েকদিন পরে মন্ত্রীসভায় এটা নিয়ে বিলও উঠবে হয়তো। বিল পাশ হওয়ার আগে আগে তাই কিছু ব্যঙ্গ করে রাখি, নচেৎ পরে আফসোস হবে। 
সড়কে দূর্ঘটনা জিনিসটা বিশ্বে খুবই দৈনন্দিন একটা ব্যপার বলা যেতে পারে। বরং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে কিশোর ও তরুণ সমাজের অকালমৃত্যুর প্রধান কারণ সড়কে দূর্ঘটনা। হিসাবে, বিশ্বে প্রতি ২৪ সেকেন্ডে একজন মানুষ সড়কে দূর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশে বছরে গড়ে মারা যাচ্ছে ২৪,৯৫৪ জন। 
আগ্রহীরা সম্পূর্ণ রিপোর্ট পড়তে পারেন। WHO Report 2018
মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে একটা কৌতুক বলে নিই। 

আমেরিকায় একবার এক বাস দূর্ঘটনায় বাসের সবাই মারা গেল। কিন্তু আশ্চর্যভাবে বেঁচে গেল বাসে থাকা একটা বানর। তো দেশের পুলিশ ভাবলো বানরটার থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দূর্ঘটনার কারণ বের করা যায়। অনেকদিন প্রশিক্ষণ দেয়ার পরে বানরটি ইশারায় কথা বুঝতে ও বলতে সক্ষম হলে বানরটিকে তদন্ত কমিটির সামনে উপস্থিত করা হলো।

কমিটিপ্রধান: যেদিন বাসের অ্যাক্সিডেন্ট হলো, বাসের সবাই কি করছিলো?
বানর: **নেচে নেচে দেখালো যে সবাই নাচছিলো**
এক কমিটিসদস্য: তারা আর কিছু করছিলো না? 
বানর: **মুখে বোতল নেয়ার ভঙ্গি করে ঢকঢক শব্দ করলো**
কমিটির আরেক সদস্য: বাসের ড্রাইভার কি করছিলো?
বানর: **নাচের ভঙ্গি আর মুখে বোতল নিয়ে ঢকঢক শব্দ করে দেখালো**
কমিটিপ্রধান: শালা সবাই যদি মদ খাচ্ছিল আর নাচছিলো, মরার বাস চালাচ্ছিলোটা কে?
বানর: **হাসতে হাসতে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরার ভঙ্গি করলো**



দেশে সরকার বিগত কয়েক বছর যাবত প্রধান সড়কগুলো সম্পূর্ণ সংস্কার করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু কাজের ধীরগতি, মৌসুমী বৃষ্টির সমস্যা, আর দেশের বাণিজ্য আর পরিবহনখাতকে বন্ধ না করে কাজ চালানো (কারণ সাময়িক বিকল্প রাস্তা তৈরী করার সুযোগ প্রায় নেই) ইত্যাদি আরও নানাবিধ সমস্যার জন্য সেটা যথেষ্ট ব্যহত হচ্ছে। এরশাদ সাহেবের সময়ে তৈরী হাইওয়েগুলোকে চারলেনের মহাসড়কে উন্নীত করা হচ্ছে, রেগুলার যাতায়াতকারীরা কিছুটা জানেন অবস্থা। এবং এতোকিছুর পরে সড়কে দূর্ঘটনার সংখ্যা খুব একটা হ্রাস পেয়েছে বললে আমার বাসায় "নিরাপদ সড়ক চাই" আন্দোলনকারীরা রেইড মারবেন। 

আসলে সড়কে দূর্ঘটনা নিয়ে বাঙালির ঠিক এই সময়টাতে মাথা ঘামানোটা আমার কাছে ফেসবুকীয় ট্রেন্ড মনে হয়। যেন এরআগে সড়কে দূর্ঘটনা কম ঘটতো। ইলিয়াস কাঞ্চণ সাহেবের স্ত্রী মারা গেলেন, বেচারা একা একা আন্দোলন করতে লাগলেন। পরিচালক তারেক মাসুদ
সাহেব মারা গেলেন সস্ত্রীক, কোনও চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়নি তেমন। হঠাৎ ইদানিং আন্দোলনটা বেশী দেখা যাচ্ছে। দেশের মানুষ কর্মহীনহায় ভুগছে মনে হয়। 


কিন্তু রাজধানীতে জিনিসটা দিনদিন বেড়েই চলেছে বললে খুব একটা অত্যুক্তি হয় বলে আমার মনে হয়না। আসলেই, ছোট্ট একটা শহরে প্রায় তিনকোটি লোকের বসবাস, আর ছোটবড় প্রায় ৫,৪০৭ টি (BRTA প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী) বাস শহরময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। দূর্ঘটনা ঘটতে কতক্ষণ, বিশেষ করে যখন বাঙালির চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র? হুড়োহুড়ি করে বাসে ওঠা নিয়ে নিন্দা জানিয়ে দুদিন আগে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, তাতে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন জন দুই ব্লগার, কারণ দেশের আবহমান সংস্কৃতির এই অবিচ্ছেদ্য অংশটির দিকে আঙ্গুল তোলার অধিকার আমার নেই। 
বাকি রইলো আসল উপায়ে প্রতিবাদ। মানে বাসমালিকদের পেটে লাথি, কিছুদিন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বর্জন করা। সেটা প্রস্তাব করলে যুক্তি আসে এতে দেশের অর্থনীতি নাকি ধ্বংস হয়ে যাবে। ইকনমিক্স বোঝেন এমন লোকেরা এই যুক্তি শুনলে হেসে কুল পাবেননা জানি, আমার কাছেও এটার কোনও উত্তর নেই। যেন কোমলমতিদের সড়ক আন্দোলনের সময়ে দেশ পঙ্গু হয়ে গেছিলো, সেটা যদি ঠিক হয়ে থাকে তো এটায় আপত্তি কেন? উত্তর সোজা, হাঁটতে হাঁটতে ভুঁড়ির অবস্থা কাহিল হয়ে যাবে। 

তো দেশের অর্থনীতি সচল রেখেও রাজধানীর এই মহাসংকট থেকে উত্তরণের উপায় একটা আছে বৈকি। সেটা কি জানেন? সেটা হচ্ছে দ্বিচক্রযান, মোটরওয়ালা নয়, একেবারে সাধারণ প্যাডেলে চালানো বাইসাইকেল। 

এক কাজ করতে পারে সরকার। ঢাকায় শুধুমাত্র বিআরটিসির বাসগুলোকে রেখে বাদবাকি সব পাবলিক বাস বন্ধ করে দিতে পারে। নিয়ম থাকবে, বিআরটিসির বাসে শুধুমাত্র অথর্ব বুড়ো ও প্রতিবন্ধিরা যাতায়াত করবে। বাদবাকি সব সুস্থ-সবল নারী পুরুষের জন্য সাইকেলে চলাচল বাধ্যতামূলক। অসুস্থদের জন্য অ্যাম্বুলেন্স আলাদা, বাদবাকি রাজধানীর সব প্রাইভেট কার উপযুক্ত কারণ ব্যতিরেকে বাইর করা নিষেধ করে দেয়া হোক। 

চিন্তা করে দেখুন, কি অসাধারণ ব্যপারটা হবে। রাজধানীর বায়ু নির্মল হতে একমাসও লাগবেনা, প্রতিদিন যাত্রীবাহী বাসের ধোঁয়ায় কলুষিত শহরটা ফিরে পাবে প্রাণ। সড়কে দূর্ঘটনা প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে আসবে, দূর্ঘটনা বলতে মাঝেমধ্যে হালকা পড়ে গিয়ে হাত-পা ছিলা, স্যাভলন দিলেই চলবে। ঢাকাবাসীদের স্বাস্থ্যে ঘটবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ডায়াবেটিস, ব্লাড-প্রেশার, স্ট্রোকের ঝুঁকি গায়েব হয়ে যাবে। পেটমোটাদের আর সকাল-সন্ধ্যা পার্কে ছুটতে হবেনা। একবার অফিসে গেলে আসলেই ক্যালরি খরচ হবে একগাদা। ঢাকা হবে বিশ্বের সবচেয়ে বেশী সুস্বাস্থ্যের অধিকারীদের শহর। 

সাইকেল সম্ভবত সবচেয়ে নিরাপদ দ্রুতগতির যানবাহন। ফাঁকা রাস্তায় এর স্বাভাবিক গতি ঘন্টায় ১৮ কি.মি. প্রায়। ঢাকায় যেকোনো প্রান্তে পৌঁছতে বাসের চেয়ে অনেক বেশী কার্যকর হবে। ফুটপাতে উঠলেও দূর্ঘটনার আশঙ্কা নেই। দেশের জ্বালানী তেল আমদানীর প্রয়োজন কমে যাবে, বাঁচবে প্রচুর খরচ। মধ্যপ্রাচ্যীয় শেখদের গোলামী শেষ। এবার নিজের চর্বি পুড়িয়ে চলো সবাই। 

সাইকেল শিখতেও বেশী সময় লাগেনা। বড়জোর দেড় থেকে দুই সপ্তাহ। দামও কম। আর এইসব সাইকেল ঠিক করতে গিয়ে একগাদা বেকার লোকের কর্মসংস্থান হবে। কর্মচ্যুত কন্ডাকটরেরা তখন রাস্তায় বসে মেকারের কাজ করবে। আহা! ভাবতেই আনন্দ। 

এমনটা চীনের বহু শহরে হয়। আধুনিক বিশ্বেও বহু শহরবাসী এই পন্থা অবলম্বন করেন। যদি বাঙালিও এইটা আয়ত্ত করতে পারতো, তাহলে হয়তো বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ থাকতোনা। 

সবশেষে একটা বাইসাইকেল জোকস: 

এক বাইসাইকেল চালককে পুলিশের গাড়ী থামতে নির্দেশ দিলো।
চালক: স্যার আমি কি করলাম? সাইকেলে তো লাইসেন্স লাগেনা।
পুলিশ: আপনি জানেন আপনার স্ত্রী পেছনের ক্যারিয়ার থেকে আধমাইল পেছনে পড়ে গেছেন?
চালক: ধন্যবাদ স্যার, আমি ভয় পাচ্ছিলাম কালা হয়ে গেলাম নাকি আবার! 


শুভকামনা সবার জন্য।

Comments