মাথার অসুখের স্বরূপ ও চিকিত্সা


শিক্ষাঙ্গনের সুস্থতা ও স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভর করে কোন দেশের সার্বিক অগ্রগতি। কারণ, প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে

.
বাংলাদেশে শিক্ষাঙ্গনের অবস্থা ভিন্ন। এখানে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় লেখাপড়ার মান ক্রমান্বয়ে কমে আসছে, বাড়ছে শিক্ষাকেন্দি ক কোচিং ও বেসরকারি পর্যায়ের শিক্ষা-বাণিজ্য। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি একাডেমিক চর্চা ম্লান করে এর রাজনৈতিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তুলছে। হাতেগোনা দু’য়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বাদ দিলে অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আকর্ষণীয় কোর্স পড়ে ব্রিলিয়ান্ট ফলাফল করে যেসব গ্রাজুয়েট বের হচ্ছেন তারা আন্তর্জাতিক চাকরির বাজারে অন্য দেশের গ্রাজুয়েটদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না। বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেসব ছাত্রছাত্রী বের হচ্ছেন তারা শিক্ষাঙ্গন থেকে শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, পরমতসহিষ্ণুতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আর জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সঙ্গে যতটা পরিচিত হচ্ছেন, তার চেয়ে বেশি পরিচিত হচ্ছেন দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি, হল দখল, সিট দখল, ভর্তি বাণিজ্য, সেশনজট, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার, ছাত্রহত্যা, অর্থের মাধ্যমে ছাত্রত্ব ক্রয়-বিক্রয়, অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি প্রভৃতি বিষয়গুলোর সঙ্গে। ফলে ছাত্ররা শিক্ষাঙ্গনে যে নৈরাজ্যিক পরিবেশে বেড়ে উঠছেন, কর্মজীবনেও সে নৈরাজ্যকে বয়ে নিয়ে লালন ও চর্চা করছেন। এরফলে শিক্ষাঙ্গনের নৈরাজের প্রভাবে সারাদেশে নৈরাজ্য বিস্তারিত হচ্ছে।
ছাত্র রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক না করে বলা যায়, আজকের ছাত্র রাজনীতি আর ছাত্রদের স্বার্থকেন্দি ক রাজনীতি নেই। ছাত্ররা এখন তাদের একাডেমিক স্বার্থের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করার পরিবর্তে জাতীয় দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। উল্লেখ্য, ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর ২১ বছরে ছাত্রদেরকে কোন জাতীয় ইস্যু বা বড় ধরনের একাডেমিক স্বার্থকেন্দি ক আন্দোলন করতে দেখা যায়নি। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়ে তারা হল দখল, সিট দখল, আধিপত্য বিস্তার, রাজপথে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তি বাণিজ্যসহ নানারকম নেতিবাচক ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়েছেন। শিক্ষাঙ্গনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হলে বড় ছাত্র সংগঠনগুলো সে শিক্ষানীতির ব্যাপারেও সেমিনার-ওয়ার্কশপ করার বা সে বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাবার সময় পাননি। ছাত্র সংগঠনগুলোকে নতুন আরপিওতে রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের পরিবর্তে সহযোগী সংগঠন বলা হলেও বাস্তবে এগুলো অঙ্গ সংগঠনের মতই ভূমিকা পালন করছে। ঐতিহ্যবাহী ছাত্র রাজনীতি থেকে ত্যাগের মহান বৈশিষ্ট্যকে যাদুঘরে পাঠিয়ে ছাত্রনেতারা এখন যেন এ রাজনীতিকে ভোগের এবং উপার্জনের সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করছেন। সাধারণ মানুষের বিপদাপদে পাশে দাঁড়াবার সনাতনী প্রবণতা ভুলে গিয়ে ছাত্রনেতারা ব্যবসা-বাণিজ্য, চাঁদা-টেন্ডারসহ বড় বড় কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ষাট-সত্তরের দশকেও জাতীয় দুর্যোগে বা মানুষের সুখে-দুঃখে ছাত্ররা মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদেরকে সাহায্য করতেন। কিন্তু এখনকার ছাত্রনেতাদের সে সময় কই? তারা এখন অনেক ব্যস্ত। ২০১১-২০১২ সালের শৈত্যপ্রবাহে উত্তর বাংলাদেশের অনেক গরীব মানুষ শীতের কষ্টে মারা গেলেও ছাত্রসমাজ বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরোনো কাপড় সংগ্রহ করে গরীবদের মাঝে বিতরণের মত কাজ করার সময় পাননি। এরকম জনসেবামূলক কাজে ছাত্রসমাজের আগ্রহ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতিবাচক ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে বর্ণাবরণে পরিচালিত শিক্ষক রাজনীতি যুক্ত হয়ে একে আরও ক্ষতিকর করে তুলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র এবং শিক্ষকরা যে রাজনীতি করছেন তা পৃথকভাবে না হয়ে প্রচ্ছন্নভাবে মিলেমিশে যাওয়ায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। এর ফলে শিক্ষকদের নিরপেক্ষতার মহান অহঙ্কার ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে। ছাত্র-শিক্ষকরা তাদের প্রধান একাডেমিক পরিচয়ের চেয়ে অনেকক্ষেত্রেই রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচিত হচ্ছেন। এটা খুবই খারাপ লক্ষণ। ছাত্র নিহত হলে তার একাডেমিক পরিচিতিকে ধামাচাপা দিয়ে গণমাধ্যমে ‘অমুক ছাত্র সংগঠনের কর্মী বা নেতা’ হিসাবে তার রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর সম্মানিত শিক্ষক-ছাত্রদের কর্মকাণ্ড দেখে উপলব্ধি করা কষ্টকর হয়ে উঠেছে যে বিশ্ববিদ্যালয় কি একটি একাডেমিক প্রতিষ্ঠান, নাকি এটি কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় ও এর ছাত্র-শিক্ষকদের একাডেমিক কর্মকাণ্ডের চেয়ে এর/এদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডই অধিক প্রচার পাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগেও দলীয় রাজনীতির তীব্র প্রভাব পড়েছে। ক্ষমতাসীন দলের আদর্শে বিশ্বাসী ও নিবেদিতপ্রাণ না হলে আকর্ষণীয় ফলাফলধারী এবং বিরল মেধার অধিকারী হয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাওয়া যাচ্ছে না। দলীয় আদর্শে নিবেদিতপ্রাণরা কম যোগ্যতা নিয়ে দলীয় সবুজ সঙ্কেতে শিক্ষকতায় আসছেন। ফলে কি শিক্ষকতায় বা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য কর্মকাণ্ডে, একনিষ্ঠ একাডেমিকরা কোণঠাসা হয়ে বর্ণধারী-দলবাজরা প্রাধান্য পাচ্ছেন। শিক্ষক নিয়োগের সময় রাজনৈতিক ভোটের অঙ্ক প্রাধান্য পাচ্ছে এবং নিয়োগদাতারা চাইছেন যাকে নিয়োগ দেয়া হবে তার ফলাফল সবচেয়ে ভাল হোক বা না হোক, তিনি শিক্ষক হিসাবে ভাল হোন বা না হোন, তাকে অবশ্যই বিশেষ দলীয় আদর্শে বিশ্বাসী হতে হবে। এজন্য নিয়োগের আগে অনানুষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে প্রার্থীদের রং যাচাই করা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। আবার নিয়োগ পাবার পর ওই শিক্ষক যেন বর্ণত্যাগ বা দলীয় আদর্শচ্যুত না হন সে ব্যাপারেও নজরদারি করা হচ্ছে। কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে নবনিযুক্ত প্রভাষকদের ভোটের আগে চায়ের দাওয়াত দিয়ে রাজনৈতিক সবক দেয়া হচ্ছে। এ কারণে ‘শত ফুল ফুটতে দাও’ নীতিতে বিশ্বাসী ও মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী কিছু স্বাধীনচেতা নবীন শিক্ষকের হূদয়ে রক্তক্ষরণ ও মস্তিষ্কে পেশা পরিবর্তন চিন্তা চলছে। এহেন দলীয় নজরদারিতে নবীন শিক্ষকদের যুগপত্ মানসিক শান্তি ও একাডেমিক চর্চা বিঘ্নিত হচ্ছে। বড় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ১৯৭৩ সালের যে বিশ্ববিদ্যালয় আইন/অধ্যাদেশ অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে তা অকার্যকর হয়ে পড়ার পরও ওই অধ্যাদেশ/আইনকে যুগোপযোগী করার কোন উদ্যোগ না নেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম ভেঙ্গে পড়েছে। এ অধ্যাদেশ/আইন শিক্ষকদেরকে অবারিত স্বাধীনতা দিলেও তাদের দায়িত্বশীলতা সুনিশ্চিত করতে পারেনি। এ অধ্যাদেশের রূপকারদের অন্যতম ড. কামাল হোসেন, প্রফেসর খান সরোয়ার মুর্শেদ প্রভৃতি ব্যক্তিত্ব এর অকার্যকারিতা স্বীকার করা সত্ত্বেও সরকার রহস্যজনক কারণে এ আইন/অধ্যাদেশকে যুগোপযোগী করার পরিবর্তে একে আসমানি কিতাবের মত সংশোধন-অযোগ্য মনে করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় হল একটি দেশের মস্তিষ্ক। এখানে হয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বাধীন চর্চা। বিশ্ববিদ্যালয় জাতিকে উপহার দেয় সুশিক্ষিত নাগরিক আর প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত অধ্যাপকরা অনুরুদ্ধ হয়ে সরকারকে দেশের উন্নয়নে সহায়তা করেন। বিশ্বব্যাপী সরকারের বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের জন্য প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে যাওয়ার রেওয়াজ থাকলেও বাংলাদেশে এ ধারা বিপরীত। এখানে সরকারের কষ্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে যাওয়া লাগে না। পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত অধ্যাপকরাই ভিসি-প্রোভিসি ও বিভিন্ন পদে যাওয়ার জন্য সরকারের কাছে দৌড়-ঝাঁপ করেন। আর সরকারের দ্বিমুখী নীতির কারণে এ দৌড় প্রতিযোগিতায় দলীয় অনুগতরাই প্রাধান্য পান। এরফলে একদিকে স্বাধীনচেতা গবেষক ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকরা যেমন কোণঠাসা হয়ে পড়েন, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-প্রোভিসি পদে ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভিসি নিয়োগ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। সরকারের দ্বিমুখী নীতি বলতে যা বুঝায় তা হল সরকার সবসময় মুখে বলে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া উচিত নয়, কিন্তু বাস্তবে যখন ডেপুটেশনে কোন বড় পদে কাউকে দায়িত্ব দেয়, তখন ভাল করে যাচাই-বাছাই করে নিজ দলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বর্ণধারী অধ্যাপক ছাড়া অন্য কোন নিরপেক্ষ একাডেমিককে সে দায়িত্ব দেয় না। সরকারের এ দ্বিমুখী নীতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ণের আবরণে দলীয় রাজনীতি চর্চা উত্সাহ পায়।
উচ্চ শিক্ষাঙ্গন আজ অসুস্থ। এ অসুস্থতার কোন চিকিত্সার উদ্যোগ নেই। নেই কোন আলাপ-আলোচনা। কেবলমাত্র কিছুদিন পর পর ক্যাম্পাসে রক্ত ঝরলে বা লাশ পড়লে শিক্ষাঙ্গনের অসুস্থতা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়, তারপর আবার তা স্তিমিত হয়ে যায়। তারপর লাশ পড়লে আবার হয় আলোচনা, কিন্তু জাতির মস্তিষ্ক, সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের চিকিত্সার উদ্যোগ নেয়া হয় না। বুয়েটে সনির লাশ পড়লে জাতি বিচলিত হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু বকর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শরীফুজ্জামান নোমানী, ফারুক হোসেন, নাসরুল্লাহ নাসিম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিউদ্দিন মাসুম, হারুন অর রশীদ, আসাদুজ্জামান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জুবায়ের আহমেদ লাশ হলে প্রতিবারই বিশ্ববিদ্যালয়ের অসুস্থতা নিয়ে সুশীল সমাজে আলোচনা উঠলেও সরকারি উদ্যোগের অভাবে তা স্তিমিত হয়ে যায়। এভাবে শিক্ষাঙ্গনের এ নৈরাজ্য আজ এক দীর্ঘমেয়াদি অসুখে পরিণত হয়েছে। জাতির মস্তিষ্কের এ দীর্ঘমেয়াদি অসুখের স্থায়ী চিকিত্সা প্রয়োজন। কিন্তু সরকারের তেমন কোন পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না। এ পরিসরে এ চিকিত্সার প্রেসক্রিপশন দেয়া যাবে না। তবে একটি অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের মাধ্যমে এ দীর্ঘমেয়াদি অসুখের চিকিত্সার সূচনা করার কথা ভাবা যায়। এ ওষুধটির নাম ‘নির্বাচন’। শিক্ষাঙ্গনে নির্বাচনের নিয়মিত চর্চার সূচনা করলে চলমান নৈরাজ্য অনেকটাই দূর হতে পারে। নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে ছাত্রনেতারা নেতৃত্বে আসার জন্য তাদের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির লক্ষ্যে সব সংগঠনের ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে তাদের মন জয়ে সচেষ্ট হবেন। চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি থেকে সরে এসে ভাল কাজের মধ্যদিয়ে সবার সমর্থন অর্জনের চেষ্টা করবেন। শিক্ষকদের মধ্য থেকে নিয়মমাফিক নির্বাচনের মাধ্যমে ভিসি নিয়োগের চর্চা শুরু করলে এক্ষেত্রেও উন্নতি হবে। দলীয় স্তাবক ও নতজানুদের পরিবর্তে তখন সুযোগ্য একাডেমিকদেরকে সাধারণ শিক্ষকরা ভিসি হবার সুযোগ করে দেবেন। প্রশ্ন হল, কঠিন না হলেও নির্বাচন করার এ কাজটির সূচনা হয় না কেন? এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা ইভিএম-এর জটিলতা নেই, কাজেই সরকার চাইলেই কি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সূচনা হতে পারে না? নিশ্চয়ই পারে। তবে সরকার হয়তো এসব ক্ষেত্রে দলীয় জয়-পরাজয়ের অঙ্ক করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। আর সেজন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন দিতে সরকারের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। আর এ কারণে জাতির মস্তিষ্ক হিসাবে বিবেচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হানাহানি, নৈরাজ্য আর দলবাজি হ্রাস না পেয়ে কিছুদিন পর পর লাশ পড়ছে।
 
 
শিক্ষাঙ্গনের সুস্থতা ও স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভর করে কোন দেশের সার্বিক অগ্রগতি। কারণ, প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে উন্নয়ন অর্জনের লক্ষ্যে যোগ্য ও মেধাবী নাগরিক তৈরির বিকল্প নেই। একটি পরিকল্পিত, প্রগতিশীল শিক্ষাঙ্গন সৃষ্টি না করে যে এ পথে এগুনো যায় না সে বিষয়টি উন্নয়নকামী দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব জানলেও সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থের উর্ধ্বে উঠতে না পারায় এরা এক্ষেত্রে ভাল করতে পারে না। বাংলাদেশ এরকম উন্নয়নকামী দেশগুলোর কাতারভুক্ত একটি দেশ। দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষা খাতের উন্নয়ন সবচেয়ে বেশি জরুরি। কারণ, অন্যসব ক্ষেত্রে কর্মরত নাগরিকরা শিক্ষা খাতের মধ্যদিয়ে যোগ্যতা অর্জন করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন। এসব শিক্ষিত নাগরিক জীবনের প্রায় দেড়যুগ শিক্ষাঙ্গনে ব্যয় করার পর কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। এ দীর্ঘ সময়ব্যাপী তারা শিক্ষাঙ্গনে যা শিখেন,তাদের কর্মজীবনে তার জোরালো প্রভাব পড়ে। একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষাজীবনে যদি শৃংখলা, নিয়মানুবর্তিতা, পরমতসহিষ্ণুতা, পেশাদারিত্ব, নিজ একাডেমিক ডিসিপ্লিনে অবদানমূলক কিছু করা প্রভৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন তাহলে পরবর্তী কর্মজীবনেও তিনি এসব চর্চায় উদ্বুদ্ধ হন। পাশ্চাত্যের শিল্পোন্নত দেশগুলোর শিক্ষাঙ্গনের দিকে তাকালে এমনই দেখা যায়।
বাংলাদেশে শিক্ষাঙ্গনের অবস্থা ভিন্ন। এখানে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় লেখাপড়ার মান ক্রমান্বয়ে কমে আসছে, বাড়ছে শিক্ষাকেন্দি ক কোচিং ও বেসরকারি পর্যায়ের শিক্ষা-বাণিজ্য। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি একাডেমিক চর্চা ম্লান করে এর রাজনৈতিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তুলছে। হাতেগোনা দু’য়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বাদ দিলে অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আকর্ষণীয় কোর্স পড়ে ব্রিলিয়ান্ট ফলাফল করে যেসব গ্রাজুয়েট বের হচ্ছেন তারা আন্তর্জাতিক চাকরির বাজারে অন্য দেশের গ্রাজুয়েটদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না। বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেসব ছাত্রছাত্রী বের হচ্ছেন তারা শিক্ষাঙ্গন থেকে শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, পরমতসহিষ্ণুতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আর জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সঙ্গে যতটা পরিচিত হচ্ছেন, তার চেয়ে বেশি পরিচিত হচ্ছেন দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি, হল দখল, সিট দখল, ভর্তি বাণিজ্য, সেশনজট, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার, ছাত্রহত্যা, অর্থের মাধ্যমে ছাত্রত্ব ক্রয়-বিক্রয়, অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি প্রভৃতি বিষয়গুলোর সঙ্গে। ফলে ছাত্ররা শিক্ষাঙ্গনে যে নৈরাজ্যিক পরিবেশে বেড়ে উঠছেন, কর্মজীবনেও সে নৈরাজ্যকে বয়ে নিয়ে লালন ও চর্চা করছেন। এরফলে শিক্ষাঙ্গনের নৈরাজের প্রভাবে সারাদেশে নৈরাজ্য বিস্তারিত হচ্ছে।
ছাত্র রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক না করে বলা যায়, আজকের ছাত্র রাজনীতি আর ছাত্রদের স্বার্থকেন্দি ক রাজনীতি নেই। ছাত্ররা এখন তাদের একাডেমিক স্বার্থের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করার পরিবর্তে জাতীয় দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। উল্লেখ্য, ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর ২১ বছরে ছাত্রদেরকে কোন জাতীয় ইস্যু বা বড় ধরনের একাডেমিক স্বার্থকেন্দি ক আন্দোলন করতে দেখা যায়নি। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়ে তারা হল দখল, সিট দখল, আধিপত্য বিস্তার, রাজপথে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তি বাণিজ্যসহ নানারকম নেতিবাচক ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়েছেন। শিক্ষাঙ্গনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হলে বড় ছাত্র সংগঠনগুলো সে শিক্ষানীতির ব্যাপারেও সেমিনার-ওয়ার্কশপ করার বা সে বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাবার সময় পাননি। ছাত্র সংগঠনগুলোকে নতুন আরপিওতে রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের পরিবর্তে সহযোগী সংগঠন বলা হলেও বাস্তবে এগুলো অঙ্গ সংগঠনের মতই ভূমিকা পালন করছে। ঐতিহ্যবাহী ছাত্র রাজনীতি থেকে ত্যাগের মহান বৈশিষ্ট্যকে যাদুঘরে পাঠিয়ে ছাত্রনেতারা এখন যেন এ রাজনীতিকে ভোগের এবং উপার্জনের সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করছেন। সাধারণ মানুষের বিপদাপদে পাশে দাঁড়াবার সনাতনী প্রবণতা ভুলে গিয়ে ছাত্রনেতারা ব্যবসা-বাণিজ্য, চাঁদা-টেন্ডারসহ বড় বড় কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ষাট-সত্তরের দশকেও জাতীয় দুর্যোগে বা মানুষের সুখে-দুঃখে ছাত্ররা মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদেরকে সাহায্য করতেন। কিন্তু এখনকার ছাত্রনেতাদের সে সময় কই? তারা এখন অনেক ব্যস্ত। ২০১১-২০১২ সালের শৈত্যপ্রবাহে উত্তর বাংলাদেশের অনেক গরীব মানুষ শীতের কষ্টে মারা গেলেও ছাত্রসমাজ বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরোনো কাপড় সংগ্রহ করে গরীবদের মাঝে বিতরণের মত কাজ করার সময় পাননি। এরকম জনসেবামূলক কাজে ছাত্রসমাজের আগ্রহ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতিবাচক ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে বর্ণাবরণে পরিচালিত শিক্ষক রাজনীতি যুক্ত হয়ে একে আরও ক্ষতিকর করে তুলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র এবং শিক্ষকরা যে রাজনীতি করছেন তা পৃথকভাবে না হয়ে প্রচ্ছন্নভাবে মিলেমিশে যাওয়ায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। এর ফলে শিক্ষকদের নিরপেক্ষতার মহান অহঙ্কার ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে। ছাত্র-শিক্ষকরা তাদের প্রধান একাডেমিক পরিচয়ের চেয়ে অনেকক্ষেত্রেই রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচিত হচ্ছেন। এটা খুবই খারাপ লক্ষণ। ছাত্র নিহত হলে তার একাডেমিক পরিচিতিকে ধামাচাপা দিয়ে গণমাধ্যমে ‘অমুক ছাত্র সংগঠনের কর্মী বা নেতা’ হিসাবে তার রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর সম্মানিত শিক্ষক-ছাত্রদের কর্মকাণ্ড দেখে উপলব্ধি করা কষ্টকর হয়ে উঠেছে যে বিশ্ববিদ্যালয় কি একটি একাডেমিক প্রতিষ্ঠান, নাকি এটি কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় ও এর ছাত্র-শিক্ষকদের একাডেমিক কর্মকাণ্ডের চেয়ে এর/এদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডই অধিক প্রচার পাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগেও দলীয় রাজনীতির তীব্র প্রভাব পড়েছে। ক্ষমতাসীন দলের আদর্শে বিশ্বাসী ও নিবেদিতপ্রাণ না হলে আকর্ষণীয় ফলাফলধারী এবং বিরল মেধার অধিকারী হয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাওয়া যাচ্ছে না। দলীয় আদর্শে নিবেদিতপ্রাণরা কম যোগ্যতা নিয়ে দলীয় সবুজ সঙ্কেতে শিক্ষকতায় আসছেন। ফলে কি শিক্ষকতায় বা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য কর্মকাণ্ডে, একনিষ্ঠ একাডেমিকরা কোণঠাসা হয়ে বর্ণধারী-দলবাজরা প্রাধান্য পাচ্ছেন। শিক্ষক নিয়োগের সময় রাজনৈতিক ভোটের অঙ্ক প্রাধান্য পাচ্ছে এবং নিয়োগদাতারা চাইছেন যাকে নিয়োগ দেয়া হবে তার ফলাফল সবচেয়ে ভাল হোক বা না হোক, তিনি শিক্ষক হিসাবে ভাল হোন বা না হোন, তাকে অবশ্যই বিশেষ দলীয় আদর্শে বিশ্বাসী হতে হবে। এজন্য নিয়োগের আগে অনানুষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে প্রার্থীদের রং যাচাই করা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। আবার নিয়োগ পাবার পর ওই শিক্ষক যেন বর্ণত্যাগ বা দলীয় আদর্শচ্যুত না হন সে ব্যাপারেও নজরদারি করা হচ্ছে। কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে নবনিযুক্ত প্রভাষকদের ভোটের আগে চায়ের দাওয়াত দিয়ে রাজনৈতিক সবক দেয়া হচ্ছে। এ কারণে ‘শত ফুল ফুটতে দাও’ নীতিতে বিশ্বাসী ও মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী কিছু স্বাধীনচেতা নবীন শিক্ষকের হূদয়ে রক্তক্ষরণ ও মস্তিষ্কে পেশা পরিবর্তন চিন্তা চলছে। এহেন দলীয় নজরদারিতে নবীন শিক্ষকদের যুগপত্ মানসিক শান্তি ও একাডেমিক চর্চা বিঘ্নিত হচ্ছে। বড় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ১৯৭৩ সালের যে বিশ্ববিদ্যালয় আইন/অধ্যাদেশ অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে তা অকার্যকর হয়ে পড়ার পরও ওই অধ্যাদেশ/আইনকে যুগোপযোগী করার কোন উদ্যোগ না নেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম ভেঙ্গে পড়েছে। এ অধ্যাদেশ/আইন শিক্ষকদেরকে অবারিত স্বাধীনতা দিলেও তাদের দায়িত্বশীলতা সুনিশ্চিত করতে পারেনি। এ অধ্যাদেশের রূপকারদের অন্যতম ড. কামাল হোসেন, প্রফেসর খান সরোয়ার মুর্শেদ প্রভৃতি ব্যক্তিত্ব এর অকার্যকারিতা স্বীকার করা সত্ত্বেও সরকার রহস্যজনক কারণে এ আইন/অধ্যাদেশকে যুগোপযোগী করার পরিবর্তে একে আসমানি কিতাবের মত সংশোধন-অযোগ্য মনে করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় হল একটি দেশের মস্তিষ্ক। এখানে হয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বাধীন চর্চা। বিশ্ববিদ্যালয় জাতিকে উপহার দেয় সুশিক্ষিত নাগরিক আর প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত অধ্যাপকরা অনুরুদ্ধ হয়ে সরকারকে দেশের উন্নয়নে সহায়তা করেন। বিশ্বব্যাপী সরকারের বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের জন্য প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে যাওয়ার রেওয়াজ থাকলেও বাংলাদেশে এ ধারা বিপরীত। এখানে সরকারের কষ্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে যাওয়া লাগে না। পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত অধ্যাপকরাই ভিসি-প্রোভিসি ও বিভিন্ন পদে যাওয়ার জন্য সরকারের কাছে দৌড়-ঝাঁপ করেন। আর সরকারের দ্বিমুখী নীতির কারণে এ দৌড় প্রতিযোগিতায় দলীয় অনুগতরাই প্রাধান্য পান। এরফলে একদিকে স্বাধীনচেতা গবেষক ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকরা যেমন কোণঠাসা হয়ে পড়েন, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-প্রোভিসি পদে ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভিসি নিয়োগ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। সরকারের দ্বিমুখী নীতি বলতে যা বুঝায় তা হল সরকার সবসময় মুখে বলে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া উচিত নয়, কিন্তু বাস্তবে যখন ডেপুটেশনে কোন বড় পদে কাউকে দায়িত্ব দেয়, তখন ভাল করে যাচাই-বাছাই করে নিজ দলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বর্ণধারী অধ্যাপক ছাড়া অন্য কোন নিরপেক্ষ একাডেমিককে সে দায়িত্ব দেয় না। সরকারের এ দ্বিমুখী নীতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ণের আবরণে দলীয় রাজনীতি চর্চা উত্সাহ পায়।
উচ্চ শিক্ষাঙ্গন আজ অসুস্থ। এ অসুস্থতার কোন চিকিত্সার উদ্যোগ নেই। নেই কোন আলাপ-আলোচনা। কেবলমাত্র কিছুদিন পর পর ক্যাম্পাসে রক্ত ঝরলে বা লাশ পড়লে শিক্ষাঙ্গনের অসুস্থতা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়, তারপর আবার তা স্তিমিত হয়ে যায়। তারপর লাশ পড়লে আবার হয় আলোচনা, কিন্তু জাতির মস্তিষ্ক, সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের চিকিত্সার উদ্যোগ নেয়া হয় না। বুয়েটে সনির লাশ পড়লে জাতি বিচলিত হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু বকর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শরীফুজ্জামান নোমানী, ফারুক হোসেন, নাসরুল্লাহ নাসিম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিউদ্দিন মাসুম, হারুন অর রশীদ, আসাদুজ্জামান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জুবায়ের আহমেদ লাশ হলে প্রতিবারই বিশ্ববিদ্যালয়ের অসুস্থতা নিয়ে সুশীল সমাজে আলোচনা উঠলেও সরকারি উদ্যোগের অভাবে তা স্তিমিত হয়ে যায়। এভাবে শিক্ষাঙ্গনের এ নৈরাজ্য আজ এক দীর্ঘমেয়াদি অসুখে পরিণত হয়েছে। জাতির মস্তিষ্কের এ দীর্ঘমেয়াদি অসুখের স্থায়ী চিকিত্সা প্রয়োজন। কিন্তু সরকারের তেমন কোন পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না। এ পরিসরে এ চিকিত্সার প্রেসক্রিপশন দেয়া যাবে না। তবে একটি অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের মাধ্যমে এ দীর্ঘমেয়াদি অসুখের চিকিত্সার সূচনা করার কথা ভাবা যায়। এ ওষুধটির নাম ‘নির্বাচন’। শিক্ষাঙ্গনে নির্বাচনের নিয়মিত চর্চার সূচনা করলে চলমান নৈরাজ্য অনেকটাই দূর হতে পারে। নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে ছাত্রনেতারা নেতৃত্বে আসার জন্য তাদের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির লক্ষ্যে সব সংগঠনের ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে তাদের মন জয়ে সচেষ্ট হবেন। চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি থেকে সরে এসে ভাল কাজের মধ্যদিয়ে সবার সমর্থন অর্জনের চেষ্টা করবেন। শিক্ষকদের মধ্য থেকে নিয়মমাফিক নির্বাচনের মাধ্যমে ভিসি নিয়োগের চর্চা শুরু করলে এক্ষেত্রেও উন্নতি হবে। দলীয় স্তাবক ও নতজানুদের পরিবর্তে তখন সুযোগ্য একাডেমিকদেরকে সাধারণ শিক্ষকরা ভিসি হবার সুযোগ করে দেবেন। প্রশ্ন হল, কঠিন না হলেও নির্বাচন করার এ কাজটির সূচনা হয় না কেন? এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা ইভিএম-এর জটিলতা নেই, কাজেই সরকার চাইলেই কি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সূচনা হতে পারে না? নিশ্চয়ই পারে। তবে সরকার হয়তো এসব ক্ষেত্রে দলীয় জয়-পরাজয়ের অঙ্ক করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। আর সেজন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন দিতে সরকারের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। আর এ কারণে জাতির মস্তিষ্ক হিসাবে বিবেচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হানাহানি, নৈরাজ্য আর দলবাজি হ্রাস না পেয়ে কিছুদিন পর পর লাশ পড়ছে।

Comments