ভ্রমণসঙ্গী


নেহা দাঁড়িয়ে আছে বাসের অপেক্ষায়। সকাল আটটায় দ্বিতীয় বাসটা আসে। এখনো পনের মিনিট বাকি। আজ সে একটু একটু আগে আগেই

.

নেহা দাঁড়িয়ে আছে বাসের অপেক্ষায়। সকাল আটটায় দ্বিতীয় বাসটা আসে। এখনো পনের মিনিট বাকি। আজ সে একটু একটু আগে আগেই চলে এসেছে। আগে আগে না আসলে সিট পাওয়া যায় না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হয়। দাঁড়িয়ে যেতে তার তেমন সমস্যা হয় না। মাত্র তো আধা ঘন্টার পথ। সমস্যাটা কতগুলো নারীলিপ্সু বদমাশ পুরুষের জন্য। কোন মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে যেন তারা ঈদের আনন্দে মেতে ওঠে। একেবারে গা ঘেষে দাঁড়াবে। আবার সৎ সাজার ভণিতা করে বলবে, “আপা, একটু চেপে দাঁড়ান”। কোথায় চাপবে সে? ও পাশেও যে আরেকটা মহা পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। তাকে চাপতে বললে গলা উঁচিয়ে বলবে, “এই ভিড়ের মধ্যে ওঠতে কে বলছে আপনাকে? একটা গাড়ি পরে আসলে চলে না?” তার ইচ্ছে করে গলা ছেড়ে চিৎকার করে বলতে, না, চলে না। কারণ, এই বাসে না গেলে সময়মত হাসপাতালে পৌঁছতে পারব না। সময়মত না পৌঁছতে পারলে আমার নার্সের চাকরিটা থাকবে না। আর চাকরিটা না থাকলে আমার ওপর ভরসা করে বসে থাকা ছোট ভাইটা আর অসহায় মা’টা না খেয়ে মরবে। পরের বাসটায় যে সিট খালি থাকবে সে গ্যারান্টি কি দিতে পারবেন আপনি?
আরো কতশত উত্তর তার মাথায় ঘোরপাক খেতে থাকে। কিন্তু সে কোন উত্তরই দেয় না।
সমস্যা একটাই, সে মেয়ে আর তারা পুরুষ। পুরুষ যখন যা ইচ্ছে করতে পারে। যা ইচ্ছে বলতে পারে। নারীরা তা পারে না। সব মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। নেহাও সহ্য করে।

সে নিজেক আরো সংকোচিত করে দাঁড়ায়। তবুও পুরুষগুলো ভালো থাকুক। তার পরও ভালো থাকে না তারা। গায়ের সাথে এসে লেপ্টে দাঁড়াবে। বাস যদি এক ডিগ্রি ঝাঁকি খায় সে সাত ডিগ্রির ভাণ করে ওপরে এসে পড়বে। নারীর কোমল দেহের মোলায়েম স্বাদ নিয়ে আবার সরি বলে পেছনে সরে যাবে। এতটুকুই পেছনে সরে দাঁড়ায় যেন আরেক বার ওপড়ে পড়া সহজ হয়।

 

এ তো হলো নিত্যদিনের ঘটনা। নেহা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল তাদের অসভ্যতায়। যেদিনই সিট না পেতো নিজেকে প্রস্তুত করে নিতো কিছু অনভিপ্রেত ঘটনার জন্য। তবে সব সময় যে এমনটা হয় তাও নয়। পাশে কোন মেয়ে দাঁড়ালে কিংবা বেশধারী নয়, প্রকৃত ভদ্র কোন পুরুষ দাঁড়ালে আরামেই পৌঁছতে পারে গন্তব্যে। তার তখন ইচ্ছে করে যাওয়ার সময় লোকটার পায়ে ধরে সালাম করতে। সবগুলো পুরুষ এমন হয় না কেন?

নেহা সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে বাসের। সামনে মাত্র একজন মাহিলা। পেছনে মধ্য বয়স্ক একজন পুরুষ। তার ভাল লাগে না পুরুষটা দেখে। কেন যেন মনে হয় এ লোকটাও অন্যদের মত। গতকালের সেই বিশ্রী মুহূর্তটা মনে পড়ে যায়।

এমনই মধ্য বয়স্ক লোক ছিল। গালে স্টাইল করা খোঁচাখোঁচা দাড়ি। দেখতে তো ভদ্রই মনে হয়েছিল প্রথমটায়। তার ভেতরটা যে এতটা কুৎসিত সেটা বাহির থেকে দেখে বুঝার জো ছিল না। লম্পট বদমাশ লোকটা এমন একটা কাণ্ড ঘটাবে সে কল্পনাও করতে পারে নি। কী বিশ্রী! মনে হলেও তার গা ঘিনঘিন করে ওঠে। মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। মানুষ এতটা নীচ, লাজহীন, বেহায়া কিভাবে হতে পারে?

গাড়িতে তখন প্রচুর ভিড় ছিল। শনিবার দিন ভিড় একটু বেশিই হয়। কারণ, অফিস আদালতগুলো এই দিনেই খোলে। তাই সবাই ব্যতিবস্ত হয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি কর্মস্থলে পৌঁছতে। নেহাও সিট পায় নি অনেকের মতো। দাঁড়িয়ে ছিল রেলিং-এ হাত রেখে। সেই লোকটি দাঁড়িয়েছিল তার ডান পাশে। প্রথমে অতটা গা ঘেষে দাঁড়ায় নি। নেহা ভেবেছিল এই ভিড়ের মধ্যেও যেহেতু লোকটা শালীনতা বজায় রেখে দূরত্ব সৃষ্টি করে রেখেছে। হয়ত ভদ্র লোকই হবে। “থাক বাবা বাঁচা গেল। এই ভিড়ের মধ্যেও যে একটা ভদ্র লোক পাওয়া গেল। শান্তিতে গন্তব্যে পৌঁছা যাবে”।
সে বুঝতে পারে নি, তার জন্য অপেক্ষা করছে অন্যকিছু।

বাস ছেড়ে দেয়। চলছে স্বাভাবিক ভাবেই। কোন ঝাঁকুনি নেই। ছোটছোট গুঞ্জন, ক্ষণেক্ষণে বাসের পিপিপ আর বাস চলার ঝনঝন শব্দ ছাড়া কোন শব্দ নেই।

আচনক ছোট একটি ল্যাণ্ডে বাসটা অল্প ঝাঁকুনি খায়। আর তখনই ঘটে ঘটনাটা। সে স্পষ্ট দেখতে পায়, লোকটা ইচ্ছে করেই তার ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। ভাবটা এমন যেন বাসের ঝাঁকুনিতে সে তাল সামলাতে পারছে না। অথচ নেহা মেয়ে হয়েও দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। শুধু হুমড়ি খেয়ে পড়লে না হয় মেনে নিত সে। কারণ, এমন প্রতিদিনই ঘটছে। আগামীতেও ঘটবে সে এটাও জানে। কিন্তু শুধু পড়াতেই তা সিমাবদ্ধ থাকে নি। লোকটা ফাঁক বুঝে নেহার ডান বগলের নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে তার নাজুক কোমল স্তনের ওপর এত জোরে একটা চাপ দেয়- সে ব্যথায় কেঁকিয়ে ওঠে। লোকলজ্জার ভয়ে গলা ছেড়ে চিৎকারও করতে পারে না সে। সেই চিৎকারটাই দলা বেঁধে গলা দিয়ে গোঙানির মত বেরিয়ে যায়। নেহা সাথে সাথে লোকটার দিকে বিস্ফারিত নয়নে ঘুরে তাকায়।কী আশ্চর্য! কিছুই না বুঝার ভাণ করে আরেক দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে সে নিঃসংকোচে।নেহা আড় চোখে এদিক ওদিক একবার দেখে নেয় কেউ দেখল কি না। যাত্রীদের অবস্থা দেখে মনে হয় দেখে নি।একটা স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে সে।কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়। এ ধরণের নীচ লোকদের হয়ত মান-সম্মান, লাজ লজ্জা কিছু নেই।কিন্তু তার তো আছে।কিভাবে লোকদের সামনে মুখ খোলবে?তার বলতেও সংকোচ হচ্ছে অথচ লোকাটার করতে দ্বিধা হলো না।
সে মনের ক্ষোভ চেপে রেখে নিজেকে আরো দূরে সরিয়ে নেয়। একেবারে বাম পাশের লোকটার সাথে গিয়ে লেপ্টে দাঁড়ায়। বাম পাশের জন ইচ্ছে করলে তাকে জায়গা করে দিতে পারে। কিন্তু নড়ছে না একটুও। মেয়েদের এমন কোমল দেহের ছোঁয়া নিতে, মজা নিতে সেও বা ছাড়বে কেন? তবুও নেহা তার সাথেই দাঁড়িয়ে থাকে। অন্যদিন খারাপ লাগলেও আজ এভাবে আরেকজনের শরীর ঘেষে দাঁড়াতে তার একটুও খারাপ লাগছে না। অন্তত ওই হায়েনাটার চেয়ে তো সে ভাল।
পরক্ষণেই আবার ভাবে, সেও যদি তার মত হয়। পরের ঝাঁকুনিতে সেও যদি এমনটা করে? ভাবতেই তার শরীরটা কাঁটাদিয়ে ওঠে। সাথে সাথে দূরে সরে যায় সে। নাহ, পুরুষদের ওপর বিশ্বাস নেই। ঠিক তখনই পাশের সিট থেকে একজন ভদ্রলোক ডেকে ওঠে, আপা, “আপনি বসেন। আমার স্টেশন সামনেই”। বলেই সে সিট ছেড়ে দেয়। অন্যদিন হলে সেও ভদ্রতা দেখিয়ে বলত, “আমিও এই সামনেই নামব। আপনি বসেন। অসুবিধা নেই”। কিন্তু আজ সে কিছুই বলল না।টুপ করে বসে পড়ল সিটে।

গাড়ির হর্ণে ধ্যান ভাঙে হেনার। গাড়ি চলে এসেছে। সিরিয়াল আগে থাকায় দাঁড়াতে হয় না। সিট পেয়ে যায়। সিটে বসে একটা স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে সে। ভাবে, এখন থেকে দেরি করা যাবে না আর।কাঁধের ব্যাগটা কোলে নামিয়ে রেখে পাশের সিটে চোখ ফেলে সে। ভ্রমণসঙ্গীটা কে? দেখার জন্য। আর সাথে সাথেই আঁতকে ওঠে সে। এটা তো গতকালের সেই লম্পট লোকটা…
এরকম আরও মজাদার গল্প বা কাহিনী পেতে আমার profile follow করেন আর সাথে থাকেন ।।।আল্লাহ হাফেজ।।।

423 Views

Comments