পশু জবাইয়ের শরয়ী বিধি-বিধান


হালাল গোস্ত / মাংস আহার করতে হবে

.

গোশত মহান আল্লাহ তায়ালার অনেক বড় নেয়ামত। প্রাচীন যুগ থেকে গোশত মানুষের খাদ্য তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করে আছে।

প্রাচীন যুগে গোশতের জন্য প্রাণী হত্যার পদ্ধতি ছিলো অদ্ভুদ। প্রাণী জবাহের বিধিবদ্ধ কোনো পদ্ধতি ছিল না। যার জন্য যেভাবে সুবিধা, সে ওই পদ্ধতিতে প্রাণী মেরে গোশত সংগ্রহ করত। কোনো প্রাণীর গোশত ভক্ষণ বৈধ আর কোনটা অবৈধ, এ ব্যাপারেও ধর্মীয় কোনো নির্দেশনা ছিলো না।

এ জন্য, কেউ মৃত প্রাণীর গোশত খেত। অনেকে জীবিত প্রাণীর দেহ থেকে গোশত কেটে খেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতো। কোথাও প্রাণীকে মেরে গোশত খাওয়ার প্রচলন থাকলেও, প্রাণীকে মারার পদ্ধতি ছিলো অত্যন্ত নির্মম। যেমন লাঠি দিয়ে পিটিয়ে, তীর নিক্ষেপ করে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে মৃত্যু নিশ্চিত করতো। এ জন্য, কোনো কোনো সময় প্রাণ বের হতে একদিনও লেগে যেতো। তারপর দেহ থেকে গোশত কেটে রান্না করে খেতো।

পশু জবাহ ও তার গোশত সংক্রান্ত সুবিন্যস্ত বিধান সর্বপ্রথম প্রবর্তন করেছে ইসলাম । যেমন মৃত প্রাণী ও এ ধরনের আরো কিছু গোশত ভক্ষণ করাকে ইসলাম হারাম করেছে। এ প্রসঙ্গে আল কোরআনে বলা হয়েছে,

حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالْدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنْزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللّهِ بِهِ وَالْمُنْخَنِقَةُ وَالْمَوْقُوذَةُ وَالْمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيحَةُ وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ إِلاَّ مَا ذَكَّيْتُمْ وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ وَأَن تَسْتَقْسِمُواْ بِالأَزْلاَمِ

অর্থ : তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে, মৃত জন্তু গোশত, প্রবাহমান রক্ত, শুকুরের গোশত, আল্লাহ ভিন্ন অন্যের নামে জবাইকৃত প্রাণীর গোশত, শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, আঘাতে মৃত জন্তু, পড়ে গিয়ে মৃত জন্তু, অন্য পশুর শিংয়ের আঘাতে মৃত জন্তু, হিংস্র পশুর খাওয়া জন্তু, তবে এ রকম প্রাণীকে যদি তোমরা মরার আগে জবাহ করে থাক এবং হারাম করা হয়েছে ওই পশু, যা পূজার বস্তুর কাছে জবাহ করা হয়। (সূরা মায়েদা-৩)

আধুনিক চিকিৎসা স্বাস্থ্যের আলোকে প্রমাণীত হয়েছে, মৃত প্রাণীর গোশত মানুষের স্বাস্থ্য ও আধ্যাত্মিকতা উভয়টার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কিছু প্রাণী আছে, যেগুলোর গোশত খেলে মানুষের আচার-ব্যবহারে পরিবর্তন আসে। ওই জন্তুগুলোর হিংস্রতা বা পশুসূলভ আচরণ ক্রমশ ভক্ষকদের থেকে প্রকাশ পেতে থাকে। যেমন শুকুর, কুকুর, বিড়াল, হিংস্র সকল প্রাণী ও পা দিয়ে ধরে খায় এমন পাখি।। ইসলাম এগুলোর গোশতকে হারাম সাব্যস্ত করেছে। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে-

عن أبي هريرة : أن رسول الله صلى الله عليه و سلم حرم يوم خيبر كل ذي ناب من السباع والمجثمة والحمار الإنسي

‘হজরত আবু হুরাইরা (রা.) সূত্রে বর্ণীত, রাসূল (সা.) খায়বর যুদ্ধে দিন ঘোষণা দিয়েছেন, আজ থেকে শিকার ধরে খায় এমন সকল পশু, তীর নিক্ষেপ করে হত্যাকৃত জন্তু ও গৃহপালিত গাধার গোশত হারাম। (তিরমিযী-১৭৯৫) কোনো কোনো বর্ণনায় শিকার ধরে খায় এমন পশুর সঙ্গে পাখির কথাও উল্লেখ রয়েছে। যে সকল পশু, পাখি শিকার ধরে খায় না, ওগুলো খাওয়া জায়েজ।

ইসলাম বলে, যে সকল পশু-পাখির গোশত খাওয়া বৈধ, ওগুলোও যেন তেনভাবে মেরে খাওয়া যাবে না। বরং এমনভাবে জবাই করে খেতে হবে, যেন নাপাক রক্ত পশুর শরীর থেকে বের হয়ে যায় এবং জন্তুরও কষ্ট কম হয়। তাই ইসলামের বিধান হচ্ছে, জবাই করার সময় মূল চারটা রগের কমপক্ষে তিনটা কাটতে হবে। এতে নাপাক রক্ত বেশি বের হবে এবং সহজে পশুর জান বের হয়ে যাবে। চিকিৎসা বিজ্ঞান স্বীকার করেছে, গোশত খেয়ে সুস্থ থাকার জন্য ইসলামী জবেহ পদ্ধতির বিকল্প কোনো পদ্ধতি হতে পারে না।

মোটকথা হচ্ছে, ফল, শাক-সবজি খাওয়ার মত, গোশত ভক্ষণের ক্ষেত্রে মানুষ সম্পূর্ণ আযাদ নয়। যার যেভাবে সুবিধা হয়, সেভাবে পশু মেরে গোশত খাওয়ার অনুমোদন ইসলাম দেয় না। বরং এ ক্ষেত্রে ইসলামের বিধিবদ্ধ আইন মেনে পশু জবাহ করতে হয়। জবাহ সংক্রান্ত শরীয়তের হুকুম ও করণীয় কিছু বিষয় নিম্নে তুলে ধরা হরো-

(এক) জবাহের সময় ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বল:

আল্লাহ তায়ালার নিকট প্রতিটি প্রাণীর জীবনের মূল্য সমান। তারপরও মহান আল্লাহ তায়ালা কিছু প্রাণীকে মানুষের জন্য হালাল করে দিয়েছেন। এটা মানুষের ওপর আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে বিশেষ অনুগ্রহ। এ জন্য করণীয় হচ্ছে, জবাহের সময় আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহের শুকরিয়া আদায় করা। শুকরিয়া আদায়ের পদ্ধতি হচ্ছে, জবাই করার সময় ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করা। কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত বিসমিল্লাহ ছেড়ে দিলে, ওই পশুর গোশত হালাল হবে না। আল কোরআনে বলা হয়েছে-

وَلَا تَأْكُلُوا مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ وَإِنَّهُ لَفِسْقٌ وَإِنَّ الشَّيَاطِينَ لَيُوحُونَ إِلَى أَوْلِيَائِهِمْ لِيُجَادِلُوكُمْ وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ

অর্থ: আর তোমরা সেই পশু থেকে খেয়ো না যার ওপর আল্লাহর নাম নেয়া হয়নি, তা খাওয়া গোনাহ। নিশ্চয় শয়তানরা নিজ বন্ধুদের প্ররোচনা দেয়, যাতে ওরা তোমাদের সঙ্গে বিতর্ক করে। তোমরা যদি ওদের কথা মেনে নাও, তবে নিশ্চয় তোমরাও মুশরিক হয়ে যাবে। (সূরা আনআম-১২১)

বিভিন্ন আয়াতে জবাই করার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলার কথা এসেছে। যেমন সূরা হজ্জ-৩৪,৩৬, সূরা আনআম-১১৯,১৩৮, সূরা নাহল-১১৫, বাকারা-১৭৩।

মাসয়ালা: হিন্দু গোশত- বিক্রেতা যদি বলে, আমি মুসলমান দ্বারা পশু বা পাখি জবাই করিয়েছি তবুও তার নিকট থেকে সেই গোশত কিনে নিয়ে খাওয়া জায়েজ নয়। অবশ্য যদি কোনো মুসলমান জবাহের সময় থেকে ক্রয়ের সময় পর্যন্ত অনবরত লক্ষ্য করে থাকে, অথবা সে চলে গেলে অন্য কোনো মুসলমান সেখানে বসে স্বচক্ষে দেখে তাহলে সেই গোশত খাওয়া জায়েজ হবে। (বেহেশতি জেওর)

(দুই) জবাই শরীয়ত সম্মত পদ্ধতিতে হওয়া:

ইসলামী, পশুর গোশত হালাল হওয়ার জন্য, যে পদ্ধতিতে প্রাণীর রুহ বের করতে বলেছে, ওই পদ্ধতিতে রুহ বের করাকেই শরীয়তের পরিভাষায় জবাই বলে। অন্য কোনো পদ্ধতিতে মেরে খেলে এটাকে জবাই বলা যাবে না। যেমন কেউ শরীয়ত নির্দেশিত পদ্ধতির বিপরীত গিয়ে, জবাইয়ের পরিবর্তে বলি দেয় তাহলে এটাকে জবাই বলা যাবে না। গৃহপালিত পশুর ক্ষেত্রে প্রাণ বের করার শরীয়ত সম্মত দুটি পদ্ধতি রয়েছে।

(১) নহর করা:

উটকে নহর করা সুন্নত। নহরের পদ্ধতি হচ্ছে, উট দাঁড়ানো অবস্থায়, গলার নিচে ধারালো কোনো অস্ত্র দ্বারা খোঁচা দিয়ে ছিদ্র করে দেয়া। শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে মৃত্যু ঘটা।

(২) জবাই করা: উট ছাড়া বাকী সকল গৃহপালিত পশুকে জবাই করা সুন্নত।

মাসয়ালা: জবাই করার সময় চারটি রগ কাটতে হবে। সে চারটি রগ হচ্ছে, শ্বাস নালী, খাদ্যনালী এবং শ্বাস নালীর দুই পার্শ্বের দুটি মোটা রগ। কোনো কারণে চারটি রগ না কেটে তিনটি কাটলে গোশত খাওয়া বৈধ হবে। কিন্তু তিনটির কম কাটলে সেই পশু বা পাখি মৃত বলে গণ্য হবে এবং তা খাওয়া বৈধ হবে না। (বেহেশতি জেওর, পৃষ্ঠা-৩৭৫)

(তিন) জবাহকারী মুসলমান হওয়া:

কোনো খাবার তৈরি করা বা রান্না করার ক্ষেত্রে তৈরিকারী কোন ধর্মের অনুসারী তা ধর্তব্য নয়। ইসলাম এখানে কোনো পার্থক্য করে নাই, সকলে সমান। সকলের তৈরি খাবার খাওয়া বৈধ। কিন্তু পশুর গোশত হালালের ক্ষেত্রে জবেহকারী মুসলমান হওয়া এবং ইহুদী নাসারাদের মধ্য থেকে যারা স্বীয় ধর্মের ওপর যথাযথ বিশ্বাস রাখে এমন হওয়া শর্ত। এতদ্ভিন্ন অন্যদের জবাইকৃত পশুর গোশত ভক্ষণ করা যাবে না।

কারণ, ‘মুসান্নিফে ইবনে আবি শায়বা’ নামক কিতাবে এক হাদীসে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘অগ্নিপূজকদের মেয়দেরকে বিবাহ করা এবং তাদের জবেহকৃত পশুর গোশত খাওয়া ছাড়া অন্য সকল বিষয়ে তাদের হুকুম আহলে কিতাবদের ন্যায়।’ উক্ত হাদীসে অগ্নিপূজকদের কথা বলা হলেও, মূর্তিপূজক, বৌদ্ধ ও প্রকৃতিপূজারীসহ এ ধরনের সকলে এখানে শামিল।

অতএব, ওদের জবেহকৃত প্রাণীর গোশত মুসলমান খেতে পারবে না। বর্তমানে অনেকে এমন আছে, যারা নামকাওয়াস্তে মুসলমান বা খৃস্টান কিন্তু প্রকৃত অর্থে তারা আল্লাহর অস্তিত্যকেই বিশ্বাস করে না। এমন লোকদের জবাহকৃত গোশত হালাল হবে না। জবাইয়ের ক্ষেত্রে উল্লেখিত তিনটি বিষয় হচ্ছে মৌলিক। এর মধ্য থেকে কোনো একটি না পাওয়া গেলে ওই পশুর গোশত খাওয়া বৈধ হবে না। বাকী যা রয়েছে, ওগুলো হচ্ছে মুস্তাহাব বা করণীয় পর্যায়ের। নিম্নে কিছু করণীয় বিষয় দেয়া হচ্ছে-

জবাহকারীর করণীয়: (এক) জবাইয়ের সময় গলা কেটে আলাদা না করা এবং এত বেশি কাটবে না যে, হারাম রগ পর্যন্ত ছুরি পৌছে যায়। রাসূল (সা.) এর এক হাদীসে বর্ণীত হয়েছে, তিনি জবাইয়ের সময় ‘নাখায়’ করতে নিষেধ করেছেন। ‘নাখায়’ বলা হয় এত বেশি কাটা যে, ছুরি হারাম রগ পর্যন্ত পৌছে যায়।

মাসয়ালা: মোরগ, পাখি জবাহের সময় অসতর্কতাবশত সমস্ত গলা কেটে গেলে সেই মোরগ বা পাখি খাওয়া জায়েজ। মাকরূহ নয়। অবশ্য এত বেশি কাটা মাকরূহ। (বেহেশতি জেওর, পৃষ্ঠা-৩৭৫)

(দুই) জবাইয়ের সময় যেন জানোয়ারের কষ্ট কম হয়, এ জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা। এক হাদীসে এসেছে, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি বস্তুর সঙ্গে ভালো আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব, আইন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কাউকে হত্যা করতে হলে, তাকে সুন্দরভাবে হত্যা কর। কোনো পশুকে জবাই করতে হলে সুন্দরভাবে কর। যেমন জবাহের আগে ছুরি ভালোভাবে ধার দিয়ে নাও।’ (সহীহ মুসলিম)

এ জন্য জবাহকারীর করণীয় হচ্ছে, ছুরিকে ভালোভাবে ধার দেয়া। এক জানোয়ারের সামনে আরেক জানোয়ার জবাহ না করা। নির্ধারিত চারটা রগ পুরা কাটা। জানোয়ারের সামনে ছুরি ধার না দেয়া। (জাওয়াহিরুল ফিকহ, খন্ড-৬, পৃষ্ঠা-১৭৮)

(তিন) পশু জবেহের সময় তার মুখ কেবলার দিকে রাখার ব্যবস্থা করা।

(চার) পবিত্র অবস্থায় জবাহ করা।

মাসয়ালা: নারী-পুরুষ উভয়ে জবাহ করতে পারবে। মুসলমান নাপাক অবস্থায় জবাহ করলেও তা হালাল হবে। (বেহেশতি জেওর, পৃষ্ঠা-৩৭৫)

(সংগৃহীত)

Comments