সন্ধ্যে নামার আগে


এটি একটি গল্প

.

“প্লিজ তোমার ভাঙা রেকর্ডটা একটু বন্ধ কর তো, সবসময় ভালো লাগে না। একেই অফিসে এত কাজের প্রেশার, বাড়ীতে একটু শান্তিতে বসব, তাও দেবে না।” প্লেট থেকে স্যান্ডুইচটা তুলে মুখে পুরতে পুরতে বেশ মেজাজের সুরেই বলল অভীক। শাওন ততক্ষণে ভিতরের ঘরে ঢুকে গেছে। দরজাটা খোলা ছিল তখনও, এবার সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে খাটের উপর গিয়ে বসল ও। অসহ্য লাগছে জাস্ট, দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এই বাড়িতে। কয়েক সেকেন্ড বসেই তড়াক করে উঠে আলমারি থেকে ব্যাগটা বের করল ও। নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো চটপট তুলতে লাগল ব্যাগে। এখন বাড়ি থেকে ব্যাগ বোঝাই করে বেরলেই নানান প্রশ্ন ধেয়ে আসবে ওর দিকে। কোথায়, কেন, কতদিনের জন্য, কবে ফিরবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যি বলতে উত্তরগুলো ওরও জানা নেই, তাই সযত্নে এড়িয়ে যাওয়াই ভাল।

বাইরের ঘরে আওয়াজ শুনে বুঝল অভীক খেয়ে উঠে পড়েছে। যেকোন সময় ঘরে ঢুকবে, নিজের মনের ভাব আর হাতের কাজ তাড়াতাড়ি গুছিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল ও। অভীক যেন ওর ঘর থেকে বেরনোর অপেক্ষাই করছিল। বেরতেই চটপট ঘরে ঢুকে রেডি হয়ে টিফিনটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ও।

ঘড়ির কাঁটা তখন ৮টা পেরিয়েছে। নেক্সট লোকালটা ধরলে ধীরে সুস্থে অফিস পৌঁছানো যায়, নয়ত সেই দৌড়ঝাঁপ। বেরিয়েই নীচে লাল্টু, ভোলা বা তপন এদের কারো একটা টোটো থাকেই। আজ যেমন তপেন ছিল, চটপট উঠে পড়ল ও। অন্যদিন ওঠার আগে উপরের ডানদিকের ব্যালকনিতে তাকায় ও। আজ আর সেসবের বালাই নেই। ব্যালকনিতে কেউ দাঁড়িয়েও নেই যদিও। টোটো ছেড়ে দিল। ব্যালকনির সাথে লাগোয়া বেডরুমের দরজাটা একচিলতে ফাঁক করা ছিল। সশব্দে সেটা বন্ধ করে দিল এবার শাওন। ইচ্ছে করছিল চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করতে, কিন্তু কার সাথেই বা চেঁচাবে ও এই ফাঁকা ফ্ল্যাটে। আয়নার সামনে চোখ গেল একবার। চোখ, মুখ, নাক রাগে সিঁদুর লাল। তাড়াতাড়ি এলোমেলো নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে হাতে ব্যাগ নিয়ে ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল ও। সামনের রাস্তা দিয়ে যাবে নাকি পিছন দিক দিয়ে এই ভেবে  ফ্ল্যাটের নীচে হতভম্বের মতন দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর পা বাড়াল সামনের টোটো স্ট্যান্ডের দিকে।

লোকাল ট্রেনে এই সময়ে পা রাখাও দুস্কর। অভীক আগে থেকে ওঠে বলেই নিজের পরিচিত সীটটা পায়। ওর সামনেই ওর বয়সী কিংবা ওর থেকে একটু ছোটই হবে, একটা ছেলে কোনোক্রমে দাঁড়িয়ে। পিঠে ব্যাগ, লাঞ্চের ব্যাগ, চোখের চশমা সামলে অতি কষ্টে দাঁড়িয়ে সে। প্রচন্ড গরমে চোখ মুখ বেয়ে পড়া ঘামটা মোছার উপায়ও নেই, তায় চোখে চশমা, বেচারার ঘেমে নেয়ে নাজেহাল অবস্থা। ছেলেটার যে এই লোকাল ট্রেনে যাতায়াতের বিশেষ অভিজ্ঞতা নেই, তা বেশ বুঝতে পারছিল অভীক।

ছেলেটার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল অভীক, “আমায় ব্যাগটা দিতে পারেন। আপনার তো অসুবিধা হচ্ছে, আমি ধরব?”

একবার বলতেই ছেলেটা হাসিমুখেই নিজের লাঞ্চব্যাগটা এগিয়ে দিল, “থ্যাংক ইউ” বলেই। একটা হাত খালি হতেই পকেট থেকে রুমালটা নিয়ে ঘামটা মুছল ছেলেটা। ছেলেটার হাসির মধ্যে একটা সারল্য আছে, ওর দিকে আলতো হেসে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল অভীক। ছেলেটার মধ্যে সাত বছর আগের নিজেকে দেখতে পাচ্ছিল ও। বিয়ের পর এইভাবেই গলদঘর্ম হয়ে লাঞ্চব্যাগ নিয়ে ট্রেনে চাপত, শাওনকে কিছু বলতেও পারত না। বড় যত্নে সাতসকালে উঠে অভীকের জন্য খাবার বানিয়ে দিত ও। অভীকেরও আর মানা করতে মন চাইত না, ব্যাগপত্র ঝুলিয়ে এভাবেই কষ্ট করে অফিস পৌঁছাত। টিফিন টাইমে বন্ধুদের সাথে খেতে বসে নিজেকে রাজা মনে হত ওর। লাঞ্চবক্সের সাথে মিশে থাকত শাওনের হাতের যত্ন। তারপর হঠাৎ কি হল কে জানে? শাওনের যত্ন করে বানিয়ে দেওয়া লাঞ্চটা বড় ভারী মনে হতে শুরু করল অভীকের। ওর বানিয়ে দেওয়া রুটি তরকারির থেকে ক্যান্টিনের চাইনিজ ডিশগুলো বেশী সুস্বাদু মনে হতে শুরু করল যেন। শাওনের দেওয়া লাঞ্চব্যাগটা একটু একটু করে কবে যেন বোঝা হয়ে গেল ওর কাছে। ওই লাঞ্চব্যাগটার জন্যই বন্ধুদের সাথে নিজের ইচ্ছে মতো যেন খেতে যাওয়া যেত না। ট্রেনে উঠে একাধিক বিরক্তির কারণও যেন ওই ব্যাগটাই। তারপর ঝেড়ে ফেলে দিল একদিন। শাওন সেদিন কিচ্ছু বলেনি, ইনফ্যাক্ট এটা নিয়ে তারপর থেকে কোন আলোচনা, আর্গুমেন্টও হয়নি। আজ হঠাৎ পুরোনো নিজেকে যেন দেখতে পেল অভীক এই ছেলেটার মধ্যে। আচ্ছা সেদিন কি শাওনের খুব কষ্ট হয়েছিল?

টোটো থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে স্টেশনের দিকে এগোল শাওন। অফিস টাইমটা চলে গেলে ভিড়টা এখন অনেকটা কমে যায়, আর লেডিস কম্পার্টমেন্টে তো কোন অসুবিধাই নেই। স্টেশন চত্বরে ঢুকে একবার স্টেশনের দিকে আর একবার টিকিট কাউন্টারের দিকে দেখল ও। কোথাকার টিকিট কাটবে ও? বাড়ি গেলে তো আরেক সমস্যা, হাজারটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে, আর সেই সব প্রশ্নের উত্তর দেবার কোন ইচ্ছা বা উপায় নেই ওর কাছে। তাহলে? প্রচন্ড গরমে দরদর করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘামছিল শাওন। হাতের ব্যাগটা পাশের বাঁধানো বেদীটায় রাখল ও। আঁচল দিয়ে কপালটা মুছল। একবার কি পিউকে ফোন করবে? এই মুহূর্তে পিউ ছাড়া আর কারো নাম মাথাতে আসছে না শাওনের। উফফ, আবার আঁচলটা চুলে আটকে গেল কেন? এত বিরক্তিকর না? চুলটা ঠিক করে কানের পাশে সরিয়েই আঁচলটায় চোখ পড়ল শাওনের। এটা অভীকের বিয়ের পর প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে দেওয়া। রঙটা যে খুব পছন্দ হয়েছিল তা নয়, কেমন যেন ক্যাটক্যাটে কমলা, তাও অভীকের খারাপ লাগবে ভেবে কিছু বলতে পারেনি। পরতে ইচ্ছে করত না, কিন্তু অভীক বললে পরতে বাধ্য হতো। কোয়ালিটিটাও যে বেশ ভাল তাও নয়। তখন অভীকের উপার্জনই বা কতটুকু। একদিন বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখতে গিয়ে এই শাড়ির জন্যই চরম লজ্জার স্বীকার হয়েছিল শাওন, সেদিন খুব রাগ হয়েছিল অভীকের উপর। বাড়ি ফিরে মনের যত রাগ, যত অভিমান সব উগড়ে দিয়েছিল ওই মানুষটার উপর। অভীক কিছু বলেনি, চুপচাপ শুনেছিল শুধু। তারপর থেকে নিজের সমস্ত জিনিস ও নিজেই কেনে, অভীক আর সারপ্রাইজের দিকে কোনদিন এগোয়নি, যেকোন অনুষ্ঠান বা কেনাকাটার সময়ই শাওনই নিজের পছন্দ মত কিনত সবকিছু। আজ বেখেয়ালেই শাড়িটা হাতের সামনে পেয়ে পরে নিয়েছিল ও। তখনকার অভীক আর এখনকার মানুষটার মধ্যে আকাশপাতাল ফারাক। শাওনের সাথে ভালোভাবে শেষ কবে কথা বলেছিল অভীক মনেও পড়ে না ওর। স্টেশন চত্বর এখন ফাঁকা, একটু আগেই একটা ট্রেন বেরিয়ে গেল, প্রচন্ড রোদে খাঁ খাঁ করছে এই দিক। গুটি কয়েক বাচ্চা ছেলের দল ফিরছে কোথাও থেকে। একজন মাঝ বয়সী মহিলা একটা বড়সড় ব্যাগ নিয়ে স্টেশন চত্বরের বাইরে  বেরোল ধীরে ধীরে, কল খুলে মুখে চোখে জল দিল খানিক। কিছুক্ষণের মধ্যেই কানে একটা চেঁচামেচির শব্দ এল, ফিরে তাকাল শাওন। চেঁচামেচি বলা ভুল, একটা ঝগড়ার পূর্বাভাস। দুটো অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে এই দিকেই এগিয়ে আসছে, ওদের মধ্যেই কথা কাটাকাটি হচ্ছে। কিন্তু পাবলিক প্লেস বলে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার বৃথা চেষ্টা করছে দুজন। ওদের কথা বলার ধরণ, হেঁটে আসার ভঙ্গিমা, এমনকি মেয়েটার রাগী রাগী মুখ, ছেলেটার মেয়েটার হাত ধরে বোঝানোর চেষ্টা, এই সবটার সাথে ভীষণ মিল পাচ্ছিল শাওন আরো দুজনের। ওই মানুষ দুটোও এরকমই ছিল, এভাবেই… ভাবনা থামিয়ে আবার ওদের দিকে চোখ গেল শাওনের। মেয়েটার চোখের কোণে জল, ছেলেটার হাতের চোট দেখে। যেন মুহূর্তের মধ্যেই হাওয়া বদল। এতক্ষণের গুমোট পরিবেশটা কেটে যেন বর্ষা নামল আকাশ ভেঙে। টুকরো টুকরো ওদের কথাগুলো ভেসে আসছিল শাওনের কানে, আর একটু একটু করে ওরা আবছা হয়ে যাচ্ছিল ওর চোখ থেকে। তার বদলে প্রকট হচ্ছিল সময়ের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া মানুষ দুটো। দায়িত্ব, কর্তব্য, চাওয়া পাওয়ার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া দুটো মানুষ। ছেলেটার চোট লাগা হাতটা জড়িয়ে বসেছিল মেয়েটা। তখনই নিজের পকেট থেকে বের করল কৌটোটা ছেলেটা। এরকম তো ঐ সিনেমা, ভিডিওতে দেখা যায়…

মফস্বলের এই স্টেশন চত্বরে নিতান্ত সাধারণ ঘরের ছেলে মেয়ে দুটো পরম যত্নে, সকলের চোখের আড়ালে আঁকলো সেই দুর্মূল্য মুহূর্তটা। যেন এই মুহূর্তটাকে বন্দী করবে বলেই ছেলেটার হাসিমুখে এই যন্ত্রনা স্বীকার করে নেওয়া। আর এই মুহূর্তটাকে বাস্তবায়িত করার জন্যই যে এত কিছু, তা বুঝতে পেরে মেয়েটার খানিক লজ্জায় আর অনেকটা ভাললাগায় অবনত মুখ। পরম যত্নে মেয়েটার আঙুলে আংটি পরানোর মুহূর্তে ছেলেটার চোখটাও একটু ছলছল করছিল না? সামনে বসা দুটো পায়রা আর কোণে বসা শাওনের ঝাপসা চোখ সাক্ষী রইল মুহূর্তটার।

আচ্ছা, অভীকও তো ওর আর শাওনের স্বপ্নের বাড়িটাকে বাস্তবায়িত করার জন্য আপ্রাণ খেটে চলেছে, সময়ের হিসাব, দিনক্ষণের হিসাব না করে শুধু ওদের ইচ্ছেপূরণের জন্য দৌড়ে চলেছে। শাওনই তো বলেছিল, ব্যস তারপর থেকে তো সেই সাধপূরণ করতেই এত তোড়জোড়, এত ব্যস্ততা, এত কিছু। আর তো কিছুদিনের অপেক্ষা। এখন তাহলে সব জেনে শুনেও কেন শাওন অভীককে সময় দিতে না পারার জন্য দায়ী করছে? শাওনই তো চেয়েছিল এই স্বপ্নপূরণের দৌড়ে শাওনের নামের সময়টাও না হয় অভীক এই দৌড়েই খরচ করুক। তাহলে আজ অভীককে কোণঠাসা করে দিচ্ছে কেন ও? আর কি ধৈর্য্য রাখতে পারছে না শাওন? গুলিয়ে যাচ্ছে কি সবটা এবার?

“এই এখানে এত ভিড় কেন?”

“কি আর বলব দাদা, সামনের নার্সিং হোমটায় কিছু একটা কেস হয়েছে শুনলাম। সেই জন্য ঝামেলা চলছে। এই জন্যই এত জ্যাম, লোকের ভিড়।”

“কি বলছ গো? কতক্ষণ বসে থাকব এখানে? এবার ট্রেন তো মিস হয়ে যাবে পরের পর। এমনিই আজ ফেরার তাড়া রয়েছে একটু আর এত দেরি হয়ে গেল। কি আশ্চর্য! আর কোন রাস্তা নেই নাকি?”

“আছে দাদা, কিন্তু সেটায় যেতে গেলেও আর একটু এগোতেই হবে। সামনে এগিয়ে ডান দিকে ঘুরে আছে একটা।”

“ব্যস, হয়ে গেল!”

 

কতক্ষণ অন্যমনস্কভাবে বসেছিল ঐ স্টেশন চত্বরে শাওন নিজেও জানে না। যন্ত্রচালিতের মতন হেঁটে টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে ট্রেনে চড়ে বসল ও। মন পড়েছিল অন্য কোথাও, যাচ্ছিল ও অন্য জায়গায়। পিউ-এর বাড়ির উদ্দেশ্যেই রওনা হল ও। অভীকের থেকে দূরে থাকার জন্যই এই সিদ্ধান্ত। ওর এই ঔদাসীন্য, ওর এই নিরুত্তাপ ব্যবহার, এই সবকিছুর জন্য দিনরাত এই অশান্তির থেকে একটু অব্যহতি চায় শাওন। তাই জন্যই কাউকে কিছু না জানিয়ে বেরিয়ে এসেছে ও। আর দুটো স্টেশন পরেই নেমে পড়বে। স্টেশনে বসেই অনেকটা সময় কেটে গেল। অন্তর্দ্বন্দটা কিছুতেই মিটছিল না। এখনও যে পুরোপুরি মিটেছে তাও নয়। ঘড়িটা দেখল একবার। সারাদিন খাওয়া হয়নি, অসহ্য ক্ষিদে পেয়েছে, মাথাটাও ধরেছে। তার মধ্যে এই প্রচন্ড গরম, আর কিছুক্ষণ পরেই তো অভীক ফিরে আসবে। ওকে দেখতে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি করবে, তখন? এই স্টেশনটায় ট্রেন একটু বেশীক্ষণ দাঁড়ায়। এইবার ছেড়ে দিল। ট্রেনটা ছাড়ার মুহূর্তেই একটা মেয়ে উঠল। খুব একটা বয়স না, দেখে মনে হচ্ছে নতুন বিয়ে হয়েছে। শাড়ীটা  অনভ্যস্ত হাতে সামলে বসল ওর সামনের সীটেই। ট্রেন ততক্ষণে স্টেশন চত্বর ছাড়তে শুরু করে দিয়েছে, অল্প গতি নিয়ে নিয়েছে। তখনই চোখে পড়ল ঘটনাটা। শাওন উল্টোদিকে মুখ করে থাকায় দেখতে পেল, মেয়েটা কিছু দেখতে পায়নি। একটা ছেলে ট্রেনের পিছনে কিছু একটা বলতে বলতে ছুটে আসছে। কি বলছে? এভাবে দৌড়াচ্ছে কেন? কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বুঝল ছেলেটার হাতে একটা লেডিস পার্স, খুব সম্ভবত এই মেয়েটারই। ট্রেনের শব্দ পেরিয়ে কান রেখে বুঝল শাওন ছেলেটা মেয়েটার নাম ধরেই ডাকছে মনে হয়। মেয়েটা এতক্ষণে বুঝতে পেরেই তাকাল ফিরে, শাওন মেয়েটার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই মেয়েটা দৌড়ে সীট থেকে উঠে দরজার কাছে গেল। ছেলেটা ততক্ষণে উঠে পড়েছে ট্রেনে।

“কি পাগলামো করছ? এভাবে কেউ দৌড়ে ট্রেনে ওঠে?”

“আরে কখন থেকে ডাকছি তোমায়, তুমি তো আর তাকাচ্ছই না। এর মধ্যেই…”

“বাজে বকবে না একদম। তুমি এরকম আর কখনো করবে না কিন্তু।”

“আচ্ছা সে ঠিক আছে, পার্সটাই তো আমার হাতে দিয়ে উঠে পড়েছ, কি হত ভাব, দৌড়তাম না তো কি করতাম? যাক গে, পরের স্টেশনে নেমে আমায় আবার ব্যাক করতে হবে। বাপের বাড়ি যাওয়ার আনন্দে সবই ভুলে মেরেছ…”

পাশ দিয়ে একটা ট্রেন পেরচ্ছে সজোরে। ওদের কথা আর কিছু কানে এল না শাওনের। হাওয়ায় ওড়া চুলগুলোকে কোনোক্রমে সামলে জানলার দিকে মনোনিবেশ করল ও।

তখনও কার লোনটা পায়নি ওরা, একটু একটু করে গোছাচ্ছে সব। বিয়ের পর কখনোই অভীককে ছাড়া বাপেরবাড়ি যায়নি শাওন, সেবারই প্রথম। অভীকের একটুও ইচ্ছে ছিল না শাওনকে একা ছাড়ার, অতি কষ্টে বুঝিয়ে রাজী করিয়েছিল ও। বাসে তুলে দিয়ে দাঁড়িয়েছিল অভীক। সামনের একটা আয়নায় অভীকের শূন্যদৃষ্টি নিয়ে ঐ তাকিয়ে থাকা দেখেছিল শাওন। বুকটা হুহু করে উঠেছিল, নিজেকে সামলে নিয়েছিল, যত দ্রুত সম্ভব কাজ সেরে অভীকের কাছে ফিরে এসেছিল ও। আসলে অভীক শাওনকে নিয়ে সবদিনই একটু বেশিই টেনশন করে। বিয়ের পরপর এই সবকিছু যেন আরও বেড়ে গেছিল, তারপর ধীরে ধীরে ব্যস্ততা, একটা মিটলে আর একটা জিনিসের চাহিদা, ইঁদুর দৌড় সবকিছু যেন একটু একটু করে গ্রাস করে নিল। এখন ওদের গাড়ি হয়েছে নিজের, সেই গাড়ি করে বাপের বাড়ি রওনা হওয়ার সময় কই আর অভীকের সেই চাহনি খুঁজে পায়না শাওন। সময়ই কোথায় একটু দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার? সবকিছু পেতে গিয়ে আর একদিকে সবকিছু রিক্ত হয়ে যাচ্ছে না তো? ঘড়িটা আবার দেখল শাওন। ওর গন্তব্য এসেই গেছে প্রায়। আচ্ছা অভীক কি ওকে ফিরে দেখতে না পেয়ে হন্যে হয়ে খুঁজবে আবার আগের মতন?

অটোটা ঘোরার ঠিক আগের মুহূর্তে ছেলেটার দিকে চোখ পড়ল অভীকের। মনোহরদার কাছে এর মধ্যেই খবরটা শুনে ফেলেছে ও। এখন চাক্ষুস ছেলেটাকে দেখল। দুই বাড়িরই অমতে ভালবেসে বিয়ে করেছিল ওরা দুজন। ছেলেটার পোস্টিং গুজরাট, মেয়েটা এখানে একাই থাকত, পেশায় স্কুল শিক্ষিকা। স্ত্রীর প্রেগন্যান্সির সময়ও ছেলেটা ছুটি না পাওয়ায় এখানে আসতে পারেনি বড় একটা। এই অবস্থায় একা থাকা, সবটা সামলানো, আর শেষ রক্ষা হল না। একটা অ্যাক্সিডেন্ট আর তারপরই… ছেলেটার শূন্যদৃষ্টি আর সব হারিয়ে ঐ হাহাকার, সহ্য করতে পারছিল না ও। বডি নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তেই ওখানে ভিড়, জটলা বেঁধেছে। গা-টা শিউরে উঠছিল অভীকের। ছেলেটা আজ যে জায়গায় দাঁড়িয়ে সেই জায়গাটা কল্পনা করার শক্তি সাহস কোনটাই নেই অভীকের মধ্যে। একটা অজানা আশংকায় ছটফট করছিল ও। ফোনটা হাতে নিয়ে কয়েক সেকেন্ড ভাবল শুধু। আজ সকালেই যা অশান্তি হয়েছে, ট্রিপটা ক্যানসেল হওয়া নিয়ে, তারপর থেকে আর একবারও কথার আদানপ্রদান হয়নি দুজনের মধ্যে। কিন্তু না, মনটা বড্ড আনচান করছে, শাওনের কিছু হয়ে গেলে অভীক আর… ফোনটা লাগাল ও। একবার, দুইবার, তিনবার… নাহ, ফোনটা বেজে গেল, শাওন ফোনটা একবারও ধরল না। এই জন্যই ফোন করতে চাইছিল না অভীক, শাওন এখন শোধ তুলবে, খুব ভাল করে জানা আছে ওর। ইচ্ছে করে ফোন ধরবে না, ইচ্ছে করে অভীককে দুশ্চিন্তায় ফেলবে, এইটাই তো চায় ও। ওকে টেনশনে ফেলে তবেই তো শান্তি। স্টেশনে পৌঁছানো অবধি আরও একবার ফোন করে উত্তর না পেয়ে রেখে দিল এবার ফোনটা অভীক। নাহ, সবকিছুর একটা সীমা আছে। কি ভাবেটা কি ও নিজেকে? আজ ফিরুক ও, তারপর… ট্রেন ঢুকে পড়ল স্টেশনে। ভাবনা থামিয়ে চটপট ট্রেনে উঠে পড়ল ও।

মনে মনে একটা চাপানউতোর চলছিলই অজানা কারণে, ফ্ল্যাটের দরজার সামনে ঝোলানো বড় তালাটা সেটা আরো বাড়িয়ে দিল। আজ সময়ের থেকে একটু আগেই ফিরে এসেছে অভীক, কিন্তু ফ্ল্যাটে তালা ঝুলবে এক্সপেক্ট করেনি। এক্সট্রা চাবি সবসময়ই থাকে কাছে, ঢুকল ফ্ল্যাটে। শাওন সামনের দোকানে বাজারে গেলে আর তালা লাগিয়ে যায় না তো। কোথায় গেল তাহলে? আবার একবার ফোন করল ও, এবার ফোনটাই সুইচ অফ! রাগের চোটে ফোনটা খাটে ছুঁড়ে ফেলে দিল অভীক।

“না না, কিছু হয়নি, বল তুমি।”

“—“

“আরে মা, বলছি তো কিছু হয়নি, আচ্ছা আমার একটা ফোন আসছে, এখন রাখছি, পরে কথা বলছি।” কোনক্রমে মায়ের ফোনটা রেখে ইনকামিং কলটা ধরল অভীক।”

“কিরে, কিছু খবর…”

“না রে , আমি রজত আর বিহুকেও জিজ্ঞাসা করলাম, রিনিদের কাছেও খোঁজ নিলাম, কোথাও যায়নি। তুই তোর শ্বশুরবাড়িতে খোঁজ করলি? ওখানেই কিন্তু যাওয়ার হাই চান্স।”

“ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম রে, যায়নি।”

“হঠাৎ কি হল? কোন ঝামেলা হয়েছিল কি? দ্যাখ, টেনশন হওয়া স্বাভাবিক। তুই প্লিজ নিজেকে শান্ত রাখ। আমি আর রজত আধ ঘন্টার মধ্যে তোর বাড়ি পৌঁছছি। তারপর কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয় হবে।”

“ওকে।” ফোনটা রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অভীক। এই ফাঁকা ফ্ল্যাটটা যেন গিলে খেতে আসছে ওকে, দম আটকে আসবে মনে হচ্ছে। মা বাবা এখনও কিছুই জানে না। কি বলবে এবার ওদের? কোথায় খুঁজবে শাওনকে? যদি সত্যিই থানা পুলিশ করতে হয়? শাওনের কোন বিপদ হল না তো? ও তো কোনদিন এরকম করে না। সকালে অশান্তির জন্যই কি…? এইভাবে শাস্তি দিচ্ছে অভীককে? কি এমন বলেছিল ও? চোখ ফেটে জল আসছে এবার অভীকের। বন্ধ ফ্ল্যাটে ঘরের কোণে সবার চোখের আড়ালে আজ অভীকের চোখে জল। দেওয়ালে টাঙানো ওদের বিয়ের ছবিতে শাওনের হাসিমুখটার দিকে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়েছিল ও। শাওনের চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে নিভৃতে নিজের মনের কথাগুলো বলল অভীক, “জাস্ট ফিরে এস, আমি আর কিচ্ছু চাই না। যাই বলি, যতই ঝগড়া করি, এইভাবে চলে যাবে? এগুলো কি? এরকম ছেলেমানুষি কেউ করে? আমরা কিন্তু ঠিক করেছিলাম, যাই হয়ে যাক কেউ কাউকে ছেড়ে যাব না। এগুলো এখন তাহলে কি হচ্ছে শাওন? তুমি বুঝতে পারছ না আমার এখন অবস্থাটা কি? কেন এরকম করছ? প্লিজ লক্ষীটি, ফোনটা ধর অন্তত একবার… আমি জানি তুমি আমার… গলাটা বুজে এল অভীকের। ফোনটা বেজে উঠল তখনই।

“হ্যাঁ, হ্যালো।”

“—“

“হোয়াট? কি যা তা বলছিস?”

“—“

“তুই রাখ আমি এখুনি আসছি।”

ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে পায়ে চটি গলিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতন এগোতে লাগল অভীক। রজতের ফোন ধরে ওকে এখানে আসতে মানা করে দিল। ফোনে পাওয়া খবরটা যদি সত্যি হয়? টেনশনে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ওর এবার। শাওনের কিছু হয়ে গেলে তো… আজ যদি ভগবানের দয়ায় সব ঠিক থাকে। সবার আগে শাওনকে সরি বলবে ও। ওর হাতটা ধরে কয়েক দন্ড বসবে ওর সাথে। এতটা দূরত্ব ওদের মধ্যে কবে থেকে চলে এল? ওরা তো ভালবেসে বিয়ে করেছিল। চারপাশের সময়টা হু হু করে পেরোতে পেরোতে কখন নিজেদের মধ্যেকার মুহূর্তটুকু  থমকে গেছে, বুঝল না? না না, এবার একটু থমকে দাঁড়ানো দরকার, শাওন শুধু সুস্থভাবে বাড়ি ফিরুক।

মিনিট কুড়ির রাস্তাটা মিনিট দশেকে পার করে হন্তদন্ত হয়ে এগোল অভীক। সামনে একটা জটলা, কিছু অপরিচিত মুখ। কি হয়েছে? শাওন ঠিক আছে তো? ফোনে যে বলল… সবাই এইভাবে ওর দিকে তাকিয়ে আছে কেন? চারপাশটা যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেছে এক লহমায়। সবটুকু যেন স্তব্ধ, নিষ্প্রাণ, বাতাস চলাচলের অনুমতিটুকুও যেন নেই আর। চারপাশে একটা দমবন্ধ করা পরিবেশ। পরিচিত মুখগুলোর ভিড়ে ও একটা মুখই খুঁজছে, ঐ মানুষটার মুখটা দেখতে পেলেই আর কিছু চায় না। শাওন ওকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারে না, এটাই ও মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। চারপাশে কে কি বলছে, কি হচ্ছে আর কোন খেয়াল নেই অভীকের। সামনের জটলাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকল ও। ওদের বাড়ির কাছের লোকাল হাসপাতাল এটাই। শাওন কোথায়? তন্নতন্ন করে ওর চোখদুটো এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে থমকে দাঁড়াল এবার। দৌড়ে এগোল ও। এই তো ওর শাওন, মাথা নীচু করে বসে আছে। ছুটে গিয়ে শাওনের হাতটা ধরল অভীক বেডের কাছে গিয়ে। তৎক্ষণাৎ বুঝল একটা অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে গেছে ইতিমধ্যেই। শাওনের হাতে আর কপালেই তার প্রমাণ স্পষ্ট। পাশের নার্স আর বাকীরা একে একে বলছিল সবটা, কিন্তু শাওন যে চুপ। কয়েক সেকেন্ড পর তাকাল অভীকের চোখের দিকে। চোখে জল, অভীক কিছু বলার আগেই চোখের ভাষায় বলে গেল অনেক কিছু। বহুদিন পর অভীকের আঙ্গুলটা ধরল শক্ত করে, ঠিক আগের মতন।

“সরি”

ব্যস, এটুকুই শুনতে পেল অভীক। প্রাণাধিক প্রিয় মানুষটাকে ফিরে পেয়েই ও খুশী, “আই অ্যাম অলসো সরি, শাওন।”

শাওনের হাতে পরম যত্নে নিজের ঠোঁটদুটো ছুঁইয়ে বলল অভীক। অতি কষ্টে আটকে রাখা চোখের জল যেন আর কথা শুনল না এবার।

“এরকম ছেলেমানুষি করে কেউ? তুমি ঝগড়া কর, কথা বল, সব ঠিক আছে, কিন্তু এরকম আর কক্ষনো করবে না তুমি। কথা দাও, আর এরপর থেকে তুমি আমায় বকবে, আমি ভুলে গেলে, সময় দিতে না পারলে ঝগড়া করবে আমার সাথে, বলছি তো। কিন্তু…” হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে কথা থামিয়ে ফিরে তাকাল অভীক, ডাক্তারবাবু হাসি মুখে দাঁড়িয়ে।

“এক্সকিউজ মি, কংগ্র্যাচুলেশন্স মিঃ অ্যান্ড মিসেস চৌধুরী, ইউ আর এক্সপেক্টিং আ বেবি!”

দুজনের মনে অভিমানের পালা চলতে চলতেই এইরকম একটা খবর দূরদূরান্তেও আশা করেনি ওরা দুজন। স্টেশনেই মাথা ঘুরে পড়ে যায় শাওন, হাতে মাথায় চোটও লাগে। হসপিটালে ওদের এক পরিচিতই ভর্তি করে অভীককে খবর দেয়। অভীক আসে, অ্যাকসিডেন্টের খবর শুনে। কিন্তু এত বড় একটা সুখবর…

দুজনেই দুজনের চোখের দিকে তাকিয়েছিল অপলক দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত, আর দেরী না করে শাওনকে নিজের বুকে আনন্দে জড়িয়ে নিল অভীক। এই তো সেই সব পেয়েছির দেশ। আর কি চাই? কখনো কখনো একটু পাগলামো, একটু দূরত্ব কিংবা একটা সরি, এগুলোই যেন বেশি জরুরি হয়ে পড়ে।শাওনের চোখের দিকে তাকাল অভীক, না বলা কথাগুলো ব্যক্ত হল চোখে চোখেই, “অনেক তো হল, চল… এবার ঘরে ফিরি চল।” একরাশ ভালোবাসা ধরা দিল দিনের শেষে, ভাগ্যিস! সন্ধ্যে নামার আগে।

356 Visualizações

Comentários