বন্ধুর প্রতি বন্ধুর ভালবাসা


বন্ধুর প্রতি বন্ধুর
ভালবাসা

.

হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠে আমার।।মোবাইল
হাতে নিয়ে দেখি সজিব।ফোন করেছে।।ফোন
রিসিভ করলাম
-দোস্ত কি করিস?
=শালা রাত ১টা বাজে কি করব আমি?
-ওহ।।ঘুম??
=হুম।।ফোন।দিয়েছিস কেন এই সময়ে কোন
সমস্যা?
-নাহ।।আমি তোর বাসার নিচে।।নিচে নাম
একটু ঘুরে আসি।।
=এই সময়ে এত রাতে?
-হুম।।চল তাড়াতাড়ি নিচে আয়।।
= আচ্ছা দাড়া আমি আসছি।।
পরিচয়টা দিয়ে নেই আমি আরিফুল ইন্টার
সেকেন্ট ইয়ার।।যার সাথে কথা বললাম সে হল
সজিব।আমরা একে উপরের বেস্ট ফ্রেন্ড।।
স্কুল জীবন থেকেই আমরা দুইজন একসাথে।।
কেউ আমাদের দুজনকে আলাদা করতে
পারেনি।।বাবা-মা মারা যাওয়ার পর আপন
বলতে আছে একমাত্র সজিব।।ওর বাসা আর
আমার বাসা কাছাকাছি।।হঠাৎ আজ এত রাতে
কেন ডাকলো বুঝতে পারছি না।।
.
-এতক্ষণ লাগে তোর নিচে নামতে?
=আরে কথা না বলে চল কোথায় যাবি।
-আরে এমনি চল একটু ঘুরি রাস্তায়।।রংপুর শহর
রাতের রাস্তা অনেক সুন্দর।
=হিমু হওয়ার শখ জাগলো কবে রে ভাই তোর?
-আরে নাহ।।ঘুম আসছিল না তাই আর কি..
=হুম।।বুঝলাম। প্রেমে পড়লি নাকি রে?
-মনে কর সেটাই।।
=কার প্রেমে পড়লি আমাকে বলবি না?
-তুই বেটা বেশি কথা বলিস চুপচাপ হাটতে
থাক।।
সেদিন রাত ৩টা পর্যন্ত ঘুমন্ত রংপুর
সৌন্দর্য উপভোগ করেছিলাম আমরা দুই বন্ধু।।
তারপর যে যার বাসায় চলে আসি।।
.
কলেজ শেষে আমি আর সজিব একসাথে
বাসায় আসি।।একদিন আমি আর সজিব কথা
বলতে বলতে বাসায় আসছিলাম।।হঠাৎ করেই
সজিব কাশতে শুরু করে।।সজিব রুমাল মুখে
দিয়ে কাশতে থাকে।।রুমাল মুখ থেকে
সরানোর পর দেখতে পাই রুমালে রক্ত।।
তারমানে কাশির সাথে সাথে রক্ত এসেছে।।
আমি এই দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে যাই।।কিন্তু
সজিব বলে এগুলা তেমন কোন ব্যাপার না।।
ঠিক হয়ে যাবে বলে সে এই ব্যাপারটা এড়িয়ে
যায়।।
.
বেশকিছুদিন ধরেই দেখছি সজিব কেমন যেন
হয়ে গেছে।।কথাবার্তা হলেও আগেরমত চঞ্চল
মনে হয় না।জিজ্ঞাসা করলেও কথা এড়িয়ে
যায়।।সজিবের আম্মুকে জিজ্ঞাসা করেও
কিছু জানতে পারিনি।।
.
একদিন দুপুরেবেলা সজিবের ফোন।
-হ্যালো।।
=আরিফ বিকালে ফ্রি আছিস?
-হ্যা।।বিকালে কাজ নেই কোন।।
=ওকে তাহলে বিকালে জমিদার বাড়ি যাব।।
তোর বাসার নিচে এসে ফোন দিব।
-ওকে।।
বিকেলবেলা;
=নিচে নাম।।
-ওকে এখনি আসছি।।
অনেকদিন পর আজ এখানে আসলাম।।আগে
প্রায় প্রতিদিন আসতাম এখানে আমি আর
সজিব।।কাজের জন্য এতদিন আসা হয়নি।।
জমিদার বাড়ি অনেক সুন্দর।।পাশেই
একটা চায়ের দোকান।।আমরা এখানে আসলে
এই দোকান থেকেই চা খেতাম।।আমি আর
সজিব নদীর পাড়ে বসলাম।
হঠাৎ সজিব বলে উঠল,
-দোস্ত একটা বেনসন কিনে আন।
.
আমি সজিবের কথা শুনে হা হয়ে গেলাম।।
কারণ আমি বা সজিব কেউ আজ পর্যন্ত
সিগারেট খাওয়া তো দূরের কথা কখনো ধরেও
দেখিনি।।তাই সিগারেট খাবে শুনে আমি
অবাক হলাম।।
=তুই সিগারেট খাবি?
-হ্যা খাব।।নিয়ে আয় যা।।
= ওকে যাচ্ছি।।
দুইটা সিগারেট কিনে নিয়ে আসলাম।।কারণ
সজিন খাবে আমি কি শুধু তাকিয়ে দেখব তাই
আমার জন্য একটা নিয়ে আসলাম।।চা
দোকানদার আমাকে সিগারেট কিনতে দেখে
হা করে তাকিয়ে ছিল।।তার কারণ টা আগেই
বলেছি।।সিগারেট আনতে না আনতে সজিব
আগুন জ্বালিয়ে সিগারেট ধরায়।।সজিবের
দেখাদেখি আমিও সিগারেট ধরালাম।।
বাতাসের সাথে মিশে যেতে থাকে আমাদের
সিগারেটের ধোয়া।সিগারেট শেষ হতেই
আরেকটা আনতে বলে আমাকে।।আমি বললাম,
-কি শুরু করলি?
=কি করলাম?
-একটার পর একটা কি শুরু করলি?
=আরে ভাই প্লিজ আজকে বাধা দিস না।।
নিয়ে আয় প্লিজ।।
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না।।হয়ত
সজিবের চোখে কিছু একটা আমি দেখতে
পেয়েছিলাম তাই আরেকটা সিগারেট এনে
দেই ওকে।।মাহিন সেটাও জ্বালিয়ে টানতে
থাকে।।আমি চেয়ে দেখি শুধু।।হঠাৎ সজিব মুখ
খুলে,
-কি আজব এই পৃথিবীটা।।তাই না?
=এই কথা কেন বলছিস?
-না এমনি।।
=কি হয়েছে তোর? আমি তো তোর ছোটবেলার
বন্ধু।।আমাকে কি বলা যায় না?
-তেমন কিছু না।।আচ্ছা তোকে একটা কথা না
বলা হয়নি।
=কি কথা?
-সাদিয়ার কথা তোকে বলা হয়নি।।
=সাদিয়া কে?
-কিছুদিন আগে আমার ফেক আইডি যেটা
দিয়ে আমি গল্প লিখি সেই আইডিতে মেয়েটি
রিকুয়েস্ট দেয়।।
=তারপর?
-আমি রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করি।।তারপর
আমাদের কথা হতে থাকে।
=হুম তারপর তোদের প্রেম হয়ে যায় একসময়
তাই তো?
-হ্যা ঠিক তাই।।
=তাহলে এখন কি হয়েছে?
আবার চুপ হয়ে যায় সজিব।আকাশ দেখতে
থাকে।।প্রশ্নের উত্তর দেয় না।
.
কিছুক্ষন পর নিরবতা ভেঙ্গে সজিব বলল,
-একটা কথা রাখবি আমার?
=কি কথা?
-আছে।।তুই শুধু কথা দে আমার কথাগুলো তুই
রাখবি?
=আচ্ছা কথা দিলাম।।
-জানিস সাদিয়া আমাকে এখনো দেখেনি।।
কিছুদিন পর সাদিয়া আসবে রংপুরে।
=তাই নাকি? ভালোয় তো।।
-হুম।।আমি দেখা করব না।।দেখা করবি তুই।।
=মানে আমি কেন দেখা করব?
-কারন আমার হাতে আর বেশি সময় নেই রে।।
=সময় নেই মানে?
-আমার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছে।।লাস্ট
স্টেজ।।আর মাত্র ৩/৪ দিন হয়ত আছে আমার
কাছে।।।
.
সজিবের মুখে এই কথা শুনে বলার ভাষা
হারিয়ে ফেলি আমি।।কতক্ষন এভাবে
তাকিয়ে ছিলাম জানি না।।কি বলব বা আমার
কি বলা উচিত বুঝতে পারছিলাম না।।সজিব
আমার দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো হাসি
দেয়।।তারপর বলে,
-বিশ্বাস হচ্ছে না।।তাই না?
=...........
-এটাই সত্যি।।
আরো কি যেন বলতে গেল সজিব তার আগেই
আমি ওকে জড়িয়ে ধরি।।চোখের পানি যেন
বাধা মানে না।।সব বাধ ভেঙ্গে সজিবকে
জড়িয়ে ধরেই আমি কেঁদে দেই।।সজিব বলে
উঠে,
-আরে কাদছিস কেন বাচ্চাদের মত?
= তুই আমাকে ছেড়ে একা যেতে পারবি? কষ্ট
হবে না তোর?
-অনেক কষ্ট হবে কিন্তু যেতে তো হবেই।।
=তুই ছাড়া এখন আমার কে আছে রে? আমি
কিভাবে থাকবো তোকে ছাড়া?
-আমার বাবা-মাকে নিজের বাবা-মা মনে
করে থাকবি।।তারা তোকে অনেক
ভালোবাসবে।।তুই সাদিয়াকে বিয়ে করে
নিস।।সাদিয়া যেন কখনো জানতে না পারে
তুই সজিব না।।সাদিয়া অনেক ভালবাসে
আমাকে।।মেয়েটির তো কোন দোষ নেই।।শুধু
শুধু কেন মেয়েটি কষ্ট পাবে? তুই সাদিয়াকে
কখনো কষ্ট দিস না।।
.
সেদিন আমি কোন উত্তর দিতে পারিনি।।কথা
যেহেতু দিয়েছি সজিবের কথা রাখতেই
হবে।।সেদিনের পরেরদিন সজিবের অবস্থা
খারাপ হয়ে যায়।।তাকে হাসপাতালে ভর্তি
করা হয়।।খবর শুনে ছুটে যাই আমি
হাসপাতালে।।সজিবকে আইসিউতে রাখা
হয়েছিল।।সেদিন সজিবের সাথে দেখা করতে
পারিনি।।তারপর দিন হাসপাতালে যাওয়ার
পর সজিব আমাকে ডেকে পাঠায়।।মুখে
অক্সিজেন মাস্ক নিয়ে শুয়ে থাকা সজিবকে
আমি চিনতে পারি নি।।আমি কাছে গিয়ে
বসতেই সজিব মাস্ক খুলে ফেলে।।আমি বাধা
দিলেও সে বাধা মানে নি।।সজিব বলে,
-কেমন আছিস?
=খুব ভালো আছি।।জানি তুই ভালো আছিস।।
আমাকে একা ছেড়ে তো চলে যাওয়ার প্লান
করেই রেখেছিস।।
-হা হা হা।।তাই আমি খুব স্বার্থপর।।আমাক
দেওয়া কথাগুলো মনে আছে?
=হ্যা মনে আছে।।
-আমার শেষ ইচ্ছা রাখবি?
=এভাবে বলিস না।।।(কাঁদতে কাঁদতে)
-মেয়েদের মত কাদিস না।।তুই সাদিয়াকে
বিয়ে করে নিস।।
=এসব তুই কি বলছিস?
-হ্যা।।সাদিয়াকে তুই বিয়ে করিস।।তুই আজ
থেকে সজিব।তোর মাঝেই আমি বেচে
থাকবো।।আমার শেষ ইচ্ছা তুই পূরণ করবি আমি
জানি।।
.
আর কিছু বলতে না দিয়ে সজিবকে জড়িয়ে
ধরি আমি।।চোখ দিয়ে অঝরে পানি পড়তে
থাকে আমার।।হঠাৎ সজিবের শ্বাস উঠে।।
আমি ডাক্তার ডেকে আনি।।ডাক্তার আমাকে
কেবিন থেকে বের করে দেয়।।বের হওয়ার সময়
সজিবের চোখে দেখেছিলাম বেচে থাকার
আকুতি।।কিন্তু না সজিব সেদিন আর ফিরে
নি।।চলে যায় না ফেরার দেশে।।কেবিন
থেকে সজিব বের হয়নি বের হয়েছিল
সজিবের নিথর দেহ।।আমার বন্ধু সজিব।।যার
সাথে আমি কাটিয়েছি আমার সব ভালো-
খারাপ মূহুর্ত।।সে আজ আমাকে ছেড়ে চলে
গেল।।সজিবের মা জ্ঞান হারান।।আমি
সজিবের নিথর দেহটির পাশে বসেছিলাম
অনেকক্ষন।।কিন্তু একবারো সজিব
জিজ্ঞাসা করেনি এভাবে হ্যাবলার মত কেন
বসে আছিস।।কেউ আর এখন রাতের বেলা ফোন
করে বলবে না চল ঘুরতে যাব।।
.
সজিব মারা যাওয়ার পর সাদিয়ার সাথে
আমি দেখা করি।।সজিবের শেষ ইচ্ছেটা আমি
পূরণ করেছি।।সাদিয়া আজো জানে না সজিব
নামের ছেলেটি যে আমি নই।।সজিব হারিয়ে
গেছে বহুদূরে।।।এটাই হয়ত বন্ধুর প্রতি বন্ধুর
ভালবাসা

1042 Views

Comments