শতবর্ষে শেখ মুজিব, ধরণীর বুকে চিরন্জিব


আমরা আজ গর্বিত বাঙালি। আমাদের স্বাধীন স্বদেশ রয়েছে। আমাদের রয়েছে লাল-সবুজের একটি পতাকা।

.

লাল-সবুজের এ পতাকা, স্বাধীনতা যাঁর নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি; তিনি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর জন্ম না হলে বাংলাদেশ হতো না। তাঁর জন্ম না হলে আমরা পরাধীন থেকে যেতাম, নিগৃহিত ও নিপীড়িত হতাম। তিনি এ বাংলায় জন্ম নিয়ে বাংলাকে ধন্য করলেন, বাংলার মানুষদের ধন্য করলেন। তাঁর কারণেই পৃথিবীর বুকে আমরা আজ গর্বিত জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে চলতে পারি। সেই মহান নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজ শততম জন্মদিন। এটি বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশিদের জন্য অনেক গৌরবের বিষয়। আমরা আনন্দিত, কারণ তাঁর শততম জন্মদিন উদযাপনে আমরা সামিল হতে পারছি। পৃথিবীজুড়ে আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালিত হবে।

ঐতিহাসিক দিন ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। এ দিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয় ছোট্ট এক শিশু। এ শিশুই একদিন হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু তাঁর জন্ম এবং বংশ পরিচয় সম্পর্কে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন। তাঁর কথায়: ‘আমার জন্ম হয় ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। আমার ইউনিয়ন হল ফরিদপুর জেলার দক্ষিণ অঞ্চলের সর্বশেষ ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের পাশেই মধুমতি নদী।...টুঙ্গিপাড়ার শেখ বংশের নাম কিছুটা এতদঞ্চলে পরিচিত। শেখ পরিবারকে মধ্যবিত্ত পরিবার বলা যেতে পারে। বাড়ির বৃদ্ধ ও দেশের গণ্যমান্য প্রবীণ লোকদের কাছ থেকে এই বংশের কিছু কিছু ঘটনা জানা যায়। আমার জন্ম হয় এই টুঙ্গিপাড়া শেখ বংশে। শেখ বোরহানউদ্দিন নামে এক ধার্মিক পুরুষ এই বংশের গোড়াপত্তন করেছেন বহুদিন পূর্বে।’

টুঙ্গিপাড়া গ্রামটি ছবির মত সুন্দর। এখানেই কেটেছে শেখ মুজিবের শৈশব-কৈশোর। বাংলার দামাল কিশোরদের মত বেড়ে উঠেছেন তিনি। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর শৈশবের দুরন্তপনা সম্পর্কে লিখেছেন: ‘আমার বাবার শৈশব কেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠোপথের ধুলোবালি মেখে, বর্ষার কাদা-পানিতে ভিজে। বাবুই পাখি বাসা কেমন করে গড়ে তোলে, মাছরাঙা কিভাবে ডুব দিয়ে মাছ ধরে, কোথায় দোয়েল পাখির বাসা; দোয়েল পাখির সুমধুর সুর আমার বাবাকে দারুণভাবে আকর্ষণ করত। আর তাই গ্রামের ছোট ছেলেদের সঙ্গে করে মাঠে-ঘাটে ঘুরে প্রকৃৃতির সঙ্গে মিশে বেড়াতে তাঁর ভালো লাগত। ছোট্ট শালিক পাখির ছানা, ময়না পাখির ছানা ধরে তাদের কথা বলা ও শিস দেওয়া শেখাতেন। বানর ও কুকুর পুষতেন। তিনি যা বলতেন, তারা তা-ই করত।’

কিশোর বয়সে শেখ মুজিব নিয়মিত খেলাধুলা করতেন। ফুটবল ছিল তাঁর পছন্দের খেলা। বঙ্গবন্ধুর ভাষ্যে জানা যায়, তিনি নিয়মিত খেলাধুলা করতেন। ফুটবল, ভলিবল ও হকি খেলতেন। তিনি খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলেন না। কিন্তু স্কুল দলের মধ্যে তার ভালো অবস্থান ছিল। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘খেলাধুলার প্রতি আমার খুব ঝোঁক ছিল। আব্বা আমাকে বেশি খেলতে দিতে চাইতেন না, আমাকে আগলিয়ে রাখতেন। আমার আব্বাও ভাল খেলোয়াড় ছিলেন।’ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর বাবা একসাথে ফুটবল খেলেছেন। ১৯৪০ সালের বঙ্গবন্ধুর টিম তাঁর বাবার টিমকে প্রায় সব খেলায় পরাজিত করেছিল। ফুটবল মাঠে বাপ-বেটার লড়াই টুঙ্গিপাড়ার মানুষ খুব উপভোগ করত। বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এ ঘটনার উল্লেখ আছে।

১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পর থেকে শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ম্যাট্রিক দিয়ে তিনি কলকাতা গিয়ে সভা-সমাবেশে যোগ দেন। মাদারীপুর গিয়ে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেন। ওই সময়ই মুসলিম লীগ বলতে গোপালগঞ্জে ‘শেখ মুজিব’কেই বোঝাত। বঙ্গবন্ধু শুরু থেকে জনগণের জন্য রাজনীতি করতেন, নিজের জন্য না। যেখানে দুর্ভোগ দেখতেন সমাধানের জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করতেন না, গরীব মানুষের প্রতি তাঁর দয়া ছিল অপরিসীম। ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ শুরু হলে শেখ মুজিবুর রহমান দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘অনেকগুলি লঙ্গরখানা খুললাম। দিনে একবার করে খাবার দিতাম। মুসলিম লীগ অফিসে, কলকাতা মাদ্রাসায় এবং আরও অনেক জায়গায় লঙ্গরখানা খুললাম। দিনভর কাজ করতাম, আর রাতে কোনোদিন বেকার হোস্টেলে ফিরে আসতাম, কোনোদিন লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে থাকতাম।’ ১৯৪৩ সালে বঙ্গবন্ধুর বয়স কত ছিল? মাত্র ২৩ বছর!

শেখ মুজিবুর রহমানের বয়স যত বেড়েছে ততই তিনি রাজনীতিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে, ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে, ৬৬ সালের ছয় দফায়, ৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে, ৭০-এর নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে টুঙ্গিপাড়ার ছোট্ট খোকাটি হয়ে ওঠেন জাতির জনক। তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার রাজনীতির কেন্দ্রিয় চরিত্র। কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বের জন্য যে সাধনা লাগে বঙ্গবন্ধুর তা ছিল। জীবনে একটিবারের জন্যও তিনি আপস করেননি। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। জেলে গেছেন, জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছেন, কিন্তু পরাজিত হননি। জীবনের তিন ভাগের একভাগ জেলে কেটেছে তাঁর। তাই পরিবারকে সময় দিতে পারেননি। বলেছেন, বাংলার মানুষই আমার পরিবার, বাংলার মানুষই আমার জীবন। এমন সফল নেতা, সংগ্রামী নেতা উপমহাদেশে আর কে আছেন? বঙ্গবন্ধুর তুলনা বঙ্গবন্ধু নিজেই।

বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে আজকের মহান দিনে কিছু কথা না বললেই নয়। কী চেয়েছেন বঙ্গবন্ধু? চেয়েছেন বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফুটুক, পেট ভরে যেন দুমুঠো ভাত এদেশের মানুষ খেতে পারে, পরাধীনতার গ্লানি ঘুচে যাক চিরতরে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে তিনি বক্তৃতায় বলেছেন, ‘আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। আমি আজ বক্তৃতা করতে পারবো না। বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী যেভাবে সংগ্রাম করেছে, আমি কারাগারে বন্দী ছিলাম, ফাঁসিকাষ্ঠে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম আমার বাঙালিকে কেউ দাবায় রাখতে পারবে না। আমার বাংলার মানুষ স্বাধীন হয়েছে।’ তিনি বলেছেন, ‘নতুন করে গড়ে উঠবে এই বাংলা, বাংলার মানুষ হাসবে, বাংলার মানুষ খেলবে, বাংলার মানুষ মুক্ত হয়ে বাস করবে, বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে এই আমার সাধনা।’

বাংলার মানুষের মুক্তি আর বাংলার মানুষের উন্নতিই ছিল বঙ্গবন্ধুর আজীবনের সাধনা। এ সাধনা থেকে তিনি কখনো সরে আসেননি। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও তিনি বাঙালিদের কথা বলেছেন। পাকিস্তানের জেলে বন্দীদশা সম্পর্কে বক্তৃতায় তিনি বলেন: ‘আমার ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে। আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিলো। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম, বলেছিলাম আমি বাঙালি আমি মানুষ, আমি মুসলমান একবার মরে ২ বার মরে না। আমি বলেছিলাম, আমার মৃত্যু আসে যদি আমি হাসতে হাসতে যাবো আমার বাঙালি জাতিকে অপমান করে যাবো না, তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইবো না। এবং যাবার সময় বলে যাবো জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙ্গালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।’ এই হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। যার কারণে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের কাছে পরাজিত হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কাছে পরাজিত হয়েছে। আমাদের ভাষা, পতাকা, স্বদেশ কেউ কেড়ে নিতে পারেনি।

মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর দেশ গড়ার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছেন। তিনি ১৯৭৩ সালে চাপাইনবাবগঞ্জে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, ‘আমার বাংলাদেশ সোনার বাংলা। আমার বাংলার মানুষ, সোনার মানুষ। আমার বাংলায় সম্পদের অভাব নাই। যদি পরিশ্রম করতে পারে, যদি সহ্য করে, আস্তে আস্তে কাজ করে, কঠোর পরিশ্রম করে, শ্রমিক ভাইয়েরা, কৃষক ভাইয়েরা, বুদ্ধিজীবীরা, সরকারি কর্মচারীরা-ইনশাল্লাহ বাংলার মানুষ একদিন সোনার বাংলা করতে পারবে।’ বরগুনায় দেওয়া ভাষণে বলেছেন, ‘আমার স্বপ্ন, আমি যদি মইরাও কোনদিন যাই, আমি যদি রাজনীতি ছেড়েও দেই, তবুও আমি দেখতে চাই আমার বাংলা সোনার বাংলা হোক, বাংলাদেশের মানুষ পেট ভরে ভাত খাক, আমার বাংলাদেশের মানুষের গায়ে কাপড় হউক, সোনার বাংলার ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া শিখুক, দুনিয়ায় বাংলাদেশের সম্মান বেড়ে যাক-এই আমার চাওয়া। এর মত পাওয়া আমার আর কিছুই নাই জীবনে, যা কোন মানুষ পায় না তা আমি পেয়েছি। তা হলো মানুষের ভালবাসা। আপনারা দোয়া করবেন-আপনাদের ভালবাসা নিয়েই আমি মরতে চাই।’

বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের সোনার বাংলা শেষ পর্যন্ত গড়তে পারেননি। এর জন্য দায়ী বিশ্বাসঘাতক আর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কুচক্র। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে তাঁর স্বপ্ন অধরা থেকে যায়। খুনিচক্র ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুকেই অস্বীকার করেছে। তাঁর নাম ও আদর্শ পৃথিবীর বুক থেকে মিটিয়ে দিতে চেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে পর্যন্ত দেওয়া হত না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালির সূর্য। তাঁকে কেউ নিভিয়ে দিতে পারেনি, পারবেও না। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এই দুঃসময় চলেছে। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। এরপর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয়বারের মত সরকার গঠন করে। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ।

এখন ২০২০ সাল। টানা ৩য় বারের মত দেশ পরিচালনা করছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর অসম্পূর্ণ কাজ তিনি সম্পন্ন করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচার এই বাংলার মাটিতে হয়েছে, দেশ কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। এককালের দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাংলাদেশ এখন দুর্নীতির সূচকে পিছিয়ে পড়েছে। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত হয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তিতে আমরা এগিয়ে গেছি। আমাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট হয়েছে। বাংলার মানুষ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। বঙ্গবন্ধু এটাই চেয়েছেন। তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ এখন আর বেশি দূরে নয়। এ সবকিছুই সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী ও দেশরত্ন শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে।

বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হতো ১০০ বছর। সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশের এত উন্নতি দেখে তিনি নিশ্চয়ই খুশি হতেন। তিনি নেই, আছে তাঁর আদর্শ এবং সংগ্রামী চেতনা যা বঙ্গবন্ধু কন্যার আছে। তিনি আমাদের বাতিঘর হয়ে শত শত বছর বাংলাদেশকে পথ দেখাবেন। শুভ জন্মদিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আপনার আদর্শে আমরা উজ্জীবিত, আমরা স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়বই ইনশাল্লাহ্। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।

 

 

Comments