সুভাষচন্দ্র বসু, নেতাজি-প্রথম পর্ব


ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম নেতা। নেতাজি নামে বিশেষভাবে অভিহিত হয়ে থাকেন।

.

সুভাষচন্দ্র বসু, ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে জানুয়ারি, বর্তমান ভারত-এর উড়িষ্যাকটক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কোদালিয়া নামক গ্রামে। তাঁর পিতা জানকীনাথ বসু ছিলেন আইনজীবী। কর্মক্ষেত্রে ছিল কটক। তাঁর মায়ের নাম প্রভাবতী দেবী।  তিনি ছিলেন পিতামাতার চোদ্দ সন্তানের মধ্যে নবম। সুভাষের জন্মের সময় তাঁর পিতামাতা কটক শহরে ছিলেন।

ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত তিনি কটক এর  একটি ইংরেজি স্কুলে পড়াশোনা করেন। বর্তমানে এই স্কুলটির নাম স্টিওয়ার্ট স্কুল (
Stewart School)। এরপর তাঁকে ভর্তি করা হয় কটকের র‌্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে (Ravenshaw Collegiate School)। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে এই স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত এই পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রেসিডেন্সি কলেজ (Presidency College)-এ ভর্তি হন। এই কলেজের ইংরেজি অধ্যাপক ওটেন ভারত-বিদ্বেষী কথাবার্তার জন্য তিনি এর বিরোধীতা করেন। ফলে অধ্যাপক ওটেন-এর সমর্থকদের দ্বারা তিনি প্রহৃত হন। এরপর কলেজ কর্তৃপক্ষ কয়েকজন ছাত্রসহ সুভাষ বসুকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করে। এরপর তিনি স্যার আশুতোষ চৌধুরী সহায়তায় স্কটিশ চার্চ কলেজে (Scottish Church College) ভর্তি হন। এই কলেজে লেখাপড়ার সময় তিনি ইউনিভার্সিটি অফিসার্স ট্রেনিং কোর-এ যোগ দেন এবং সমরবিদ্যার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে এই কলেজ থেকে তিনি দর্শনে বি.এ (সম্মান) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর অভিভাবকরা তাঁকে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য বিলাত পাঠান ।

 

ইংল্যান্ডে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজউইলিয়াম হলে উচ্চশিক্ষার্থে ভর্তি হন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই কলেজের পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান লাভ করেন এবং মরাল সায়েন্স কেম্ব্রিজ ট্রাইপস অধিকার করেন। ইতিমধ্যে ভারতে নানা রকমের ঘটনা ঘটে যায়। যেমন ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে রাউটাল বিল বাতিলের জন্য গান্ধীজী দরখাস্ত করেন। এপ্রিল মাসে সর্বভারতীয় সত্যগ্রহ আন্দোলন শুরু হয় এবং হরতাল পালিত হয়। এরপর পাঞ্জাবে তাঁর প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলে, গান্ধীজী পাঞ্জাবে প্রবেশের চেষ্টা করেন। এই কারণে দিল্লী যাওয়ার পথে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৩ই এপ্রিল তারিখে জালিয়ানওয়ালাবাগে হত্যাকাণ্ডের পর গান্ধীজী সবরমতী আশ্রমে ৩ দিনের উপবাস করেন। ১৪ই এপ্রিল তারিখে নদীয়াতে স্বীকার করেন যে, সত্যাগ্রহ করে তিনি হিমালয়তূল্য ভুল করেছেন। গান্ধীজী'র এই আন্দোলন এবং জালিয়ানওয়ালাবাগে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর, সুভাষ তীব্র বৃটিশ বিরোধী হয়ে উঠেন। ফলে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা প্রত্যাখ্যান করে তিনি ভারতে ফিরে আসার উদ্যোগ নেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, "কোনো সরকারের সমাপ্তি ঘোষণা করার সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হল তা থেকে [নিজেকে] প্রত্যাহার করে নেওয়া"।

 

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুলাই জাহাজ থেকে নেমে গান্ধীজী'র সাথে দেখা করেন। গান্ধীজী'র নির্দেশে তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সাথে দেখা করেন। উল্লেখ্য এই সময় চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন সবার রাজনৈতিক গুরু। কলকাতায় ফিরে তিনি চিত্তরঞ্জন দাশের অনুপ্রেরণায় স্বরাজ নামক সংবাদপত্রে লেখালিখি শুরু করেন এবং বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রচার দায়িত্বে নিযুক্ত হন। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে দেশবন্ধু যখন কলকাতা পৌরসংস্থার মেয়র নির্বাচিত হন, তখন সুভাষচন্দ্র তাঁর অধীনে কর্মরত ছিলেন। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে অন্যান্য জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে তাঁকেও বন্দী করা হয় এবং মান্দালয়ে নির্বাসিত করা হয়। উল্লেখ্য ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের রেগুলেশন দ্বারা তিনি বন্দী হয়েছিলেন। এখানে তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।


১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান। এই বৎসরে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। এই সময় বাংলার কংগ্রেস দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এই দুটি দল সেনগুপ্ত কংগ্রেস এবং সুভাষ কংগ্রেস নামে চিহ্নিত হতো। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতা কংগ্রেসকে সামরিক কায়দায় সাজান। এক্ষেত্রে তিনি যে বিশেষ বাহিনী গড়ে তোলেন, তার নাম ছিল  'বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স'। সে সময়ে  'বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স' বাহিনীতে নারী ও পুরুষ বিপ্লবী ছিল। 'বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স' বাহিনীকে সামরিক মানসিকতায় শিক্ষা প্রদান করা হয় এবং এ বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে স্বাধীনতার জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করা হয়। 'হিন্দুস্থান সেবক দল' নামে আরেকটি বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল।

 

১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশন হয়। এই অধিবেশনে সভাপতি ছিলেন জহরলাল নেহেরু। এই সময় সুভাষ বসুর নেতৃত্বে গড়ে উঠা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এই অধিবেশনকে বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত করে তোলে। এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন সুভাষবসু। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল সে সময়ের বিভিন্ন সশস্ত্র বিপ্লবীদল। এই দলগুলোর ভিতর উল্লেখযোগ্য দলগুলো ছিল অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর, পূর্ণদাস বাউলের দল, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন বিপ্লবী সংগঠন। কংগ্রেসের এই অধিবেশনের জন্য বিশাল প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তিনি।

 

১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বঙ্গীয় প্রদেশিক কংগ্রেস অধিবশেন সভাপতিত্ব করেন। এই বৎসরের আগষ্ট মাসে 'নিখিল ভারত লাঞ্ছিত রাজনৈতিক দিবস' উপলক্ষে তিনি একটি শোভাযাত্রা পরিচালনা করেন। এই কারণে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯২৯ লাহোরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে তিনি ও বিপ্লবীরা ব্রিটিশ সরকারের পাশাপাশি একটি সমান্তরাল সরকার গঠন করার প্রস্তাব করেন।

 

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ শে জানুয়ারি মাসে দেওয়া রায়ে তাঁর ৯ মাসের জেল হয়। আর ১৮ই এপ্রিল সূর্যসেন মোট ৬৫ জন যোদ্ধা নিয়ে, প্রায় রাত দশটার দিকে আক্রমণ করে চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনে অবস্থিত অস্ত্রাগার দখল করেন। এই ঘটনা ব্রিটিশ ভারতের শাসকদের প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল। চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের বেশিরভাগ শহীদ হন, কিন্তু অবশিষ্টদের খোঁজার জন্য ব্রিটিশ পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড় ও নির্যাতন শুরু করে। এরই ভিতর  ২৩ সেপ্টেম্বর সুভাষ জেল থেকে ছাড়া পান। এই বৎসরেই ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন।

 

১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে উত্তরবঙ্গে সাংগঠনিক কাজে গেলে, মালদহের ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর জেলায় ঢুকতে বাধা দেয়। এই বাধা অগ্রাহ্য করলে তাঁকে গ্রেফতার করে ৭ দিনের জেল দেওয়া হয়। ২৬ জানুয়ারিতে তিনি কলকাতায় একটি শোভাযাত্রা করলে, পুলিশ শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারী জনগণকে বাধা দেয়। এই সময় পুলিশের লাঠচার্জে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। অজ্ঞান অবস্থায় পুলিশ তাঁকে বন্দী করে হাসপাতালে পাঠায়। বিচারে তাঁর ছয় মাসের জেল হয়েছিল। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই মার্চ গান্ধী-অরুইন চুক্তি হয়। এই চুক্তি অনুসারে অন্যান্য সকল রাজনৈতিক বন্দীদের সাথে তিনিও মুক্তি পান। উল্লেখ্য ৮ই মার্চ তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।

 

১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ শে অক্টোবর ঢাকা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ডুর্নোকে হত্যা করেন তৎকালীন বাংলার দুই বিপ্লবীসরোজ গুহ এবং রমেন ভৌমিক। এঁদের পুলিশ ধরতে না পেরে, ঢাকার স্থানীয় লোকদের উপর নির্যাতন শুরু করে। এর প্রতিবাদে তিনি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ থেকে একটি নোটিশ দ্বারা তাঁকে ঢাকা প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। এই সময় তাঁর সঙ্গীদের ঢাকাতে প্রবেশ করতে দেওয়া হলেও তাঁকে স্টিমারের করে চাঁদপুরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।  চাঁদপুর থেকে তিনি আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ১১ নভেম্বর তাঁকে তেজগাঁও রেল স্টেশনে গ্রেফতার করা হয়। ১৪ নভেম্বর ৫০০ টাকা জামিনে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৫ই নভেম্বর পুলিশি নির্যাতনে ঢাকার ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর সাথে দেখা করেন। পরে সরকার তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভোযোগ তুলে নিয়েছিল।

 

১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ১ লা জানুয়ারিতে কংগ্রেসর ওয়ার্কিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় ইংরেজের সকল ধরনের রাজনৈতিক অত্যাচারের বন্ধ করার দাবি করা হয় এবং সাতদিনের মধ্যে এই দাবি না মানলে, আইন-অমান্য আন্দোলন-এর হুমকি দেওয়া হয়। এই সূত্রে সরকার গান্ধীজী, জহরলাল নেহেরু, বল্লভ ভাই প্যাটেল-সহ বহু নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে। বোম্বে থেকে ফেরার পথে , বোম্বে রেলস্টেশনের ৩০ মাইল দূরে কল্যাণপুরে সুভাষ বসুকে গ্রেফতার করে প্রথমে মধ্য প্রদেশের সিডনী সাবজেলে পাঠানো হয়। পরে তাঁকে জব্বলপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হয়। জেলে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হলে, তাঁকে ভাওয়াল স্বাস্থ্য নিবাসে পাঠানো হয়। ক্রমে ক্রমে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হলে, তাঁকে চিকিৎসার জন্য ইউরোপ যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।

 

১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি ভিয়েনার উদ্দেশ্যে বোম্বে থেকে জাহাজযোগে রওনা দেন। ৮ই মার্চ তিনি ভিয়েনা পৌঁছান। একটু সুস্থ হয়ে তিনি ইউরোপের সুইজারল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড ইত্যাদি দেশ ভ্রমণ করেন।

 

১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে ভিয়েনাতে থাকার সময় তিনি একজন ইংরেজি জানা সেক্রেটারি খুঁজছিলেন। এই সময় তাঁর সাথে অস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভুত এমিলি (Emilie Schenkl)-এর সাথে দেখা হয়। এক সাথে কাজ করার সূত্রে, এমিলি'র সাথে তাঁর প্রণয়ের সূত্রপাত হয়। এই বৎসরের ডিসেম্বর মাসে পিতার অসুস্থার সংবাদ শুনে ভারতে ফিরে আসেন। কিন্তু সরকার তাঁকে নির্বাসিত করে ভারত ত্যাগের নির্দেশ দেয়। ফলে তিনি ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জানুয়ারি আবার ইউরোপে ফিরে যান। এই সময় ভারত থেকে প্রথমে তিনি ইতালিতে আসেন। এখানে তাঁর সাথে দেখা হয় মুসেলিনির। ১৬ই জানুয়ারি তাঁর 'ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল' নামক বইটি প্রকাশিত হলে, ইউরোপে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

 

১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ এপ্রিল তিনি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভারতে ফিরে আসেন। বোম্বের জাহাজ ঘাট থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১০ মে সুভাষ দিবস পালিত হয়। সুভাষ বসুকে কার্শিয়াং-এর গির্দা পাহাড়ের এক জেলখানায় রাখা হয়েছিল। ডিসেম্বর মাসে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হলে, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। ৬ এপ্রিল তাঁকে কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্কে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য পুনোরুদ্ধারের জন্য ডঃ ধর্মবীরের নির্দেশে ১৮ই নভেম্বর তিনি আবার ইউরোপ যান।

 

১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রেমিকা এমিলি-কে বিবাহ করেন এবং ইউরোপে তাঁর স্ত্রীর সাথে কাটান।

১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে বিদেশে থাকাবস্থায় হরিপুরা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে সভাপতির পদে তিনি প্রতিযোগিতা করেন। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই জানুয়ারি কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারি আচার্য কৃপালিনী- সুভাষ বসুকে কংগ্রেসের সভাপতি ঘোষণা করেন। মূলত এতকাল কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনে গান্ধীজী'র ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটতো। এই নির্বাচনে গান্ধীজী পরোক্ষভাবে বিরোধিতা করা সত্ত্বেও সুভাষ বসু জয়লাভ করেন। এই জয়লাভের পর, ইংল্যাণ্ডের ডরচেস্টারের প্রবাসী ভারতীয় এবং ইংরেজ রাজনীতিবিদরা তাঁকে সম্বর্ধনা দেন। এরপর ২৪ জানুয়ারিতে তিনি বিমানযোগে করাচিতে পৌঁছান।

 

১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ত্রিপুরা কংগ্রেস নির্বাচনে সভাপতির পদে প্রতিযোগিতায় প্রাথমিকভাব অংশগ্রহণ করেন মৌলানা আজাদ, পট্টভি সিতারামায়া এবং সুভাস বসু। গান্ধীজী পট্টভি সিতারামায়াকে সমর্থন করায় মৌলানা আজাদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান এবং পট্টভি সিতারামায়াকে সমর্থন করেন। এই সময় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির অধিকাংশই পট্টভি সিতারামায়া-এর স্বপক্ষে নগ্নভাবে সমর্থন জানান। এতকিছুর পরেই সুভাস বসু জয়লাভ করেন। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হয়েছিল ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে জানুয়ারি। এই নির্বাচনে সুভাস বসু পেয়েছিলেন ১৫৭৫ ভোট, আর পট্টভি সিতারামায়া পেয়েছিলেন ১৩৪৬ ভোট। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর, গান্ধীজীর এক বিবৃতিতে জানান, "...পট্টভি সিতারামায়ার পরাজয় আমারই পরাজয়।...হাজার হোক সুভাষবাবু দেশের শত্রু নন!...তাঁর জয়লাভে আমি আনন্দিত।"

 

যেহেতু নগ্নভাবে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির অনেক সদস্যই পট্টভি সিতারামায়া-কে সমর্থন করেছিলেন। ওয়ার্কিং কমিটির সাথে সুভাষ বসুর দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলার জন্য, সুভাষ বসু ১৫ই ফেব্রুয়ারি গান্ধীজীর সাথে দেখা করার জন্য সেবাগ্রাম যান। প্রাথমিকভাবে গান্ধীজী এই দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে বলেন সুভাষ ইচ্ছা করলে তাঁর মনমতো নতুন ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করতে পারেন। পরে গান্ধীজী দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু সেটাও ছিল ছলনাপূর্ণ। তারপরেও তিনি অপর এক বিবৃতিতে বলেন 'আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, গোড়া থেকেই আমি তাঁর (সুভাষের) পুননির্বাচনের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলাম। এর কারণ আজ আমি বলতে চাই নে।' অবশ্য সে কারণ গান্ধীজী কখনোই আর ব্যাখ্যা করেন নি।

 

সুভাষ বসুর সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর, ২২শে ফেব্রুয়ারি ওয়ার্কিং কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এই সভায় ব্যক্তিগত কাজের অজুহাতে গান্ধীজী যোগদান করেন নি।  আর স্বাস্থ্যগতকারণে ডঃ নীলরতনের পরামর্শে সুভাষ বসু অনুপস্থিত থাকেন। ফলে সুভাষ বসু ছাড়াই সভার কাজ শুরু হয়। একরম বিনা কারণেই, এই সভায় ১২ জন ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য পদত্যাগ করেন। অবশেষে ৫ মার্চ সুভাষ বসু জ্বর নিয়ে ত্রিপুরার উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু প্রচণ্ড জ্বরের জন্য তাঁকে এ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। সভাপতির চেয়ারে রাখা হয় তাঁর প্রতিকৃতি। তাঁর পক্ষে লিখিত ভাষণ পাঠ করে শোনান তাঁর মেজ দাদা শরৎচন্দ্র বসু। এই সভায় শেষ পর্যন্ত গান্ধীর সমর্থকদের নিয়ে কমিটি তৈরি হয়েছিল।

 

২১ এপ্রিল সুভাষ বসু সুস্থ হয়ে কলকাতায় ফেরেন। নিখিল ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতির অধিবেশনে যোগাদানের জন্য কলকাতায় গান্ধীজী আসেন ২৭ এপ্রিল। ২৮ এপ্রিল ওয়েলিংটন স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত এই অধিবেশনে গান্ধীজীর  এবং সুভাষ বসুর ভিতর দীর্ঘ আলোচনা হয়, কিন্তু গান্ধীজী কংগ্রেস সভাপতি সুভাষ বসুর বিরুদ্ধেই থেকে যান। শেষ পর্যন্ত সুভাষ বসু পদত্যাগ পত্র জমা দেন এবং সাথে সাথে গৃহীত হয়। এরপর নতুন সভাপতি নির্বাচিত হন- গান্ধীজীর প্রিয়ভাজন বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ।

 

এরপর থেকে কংগ্রেসের সাথে ক্রমান্বয়ে তাঁর বিরোধ হতে থাকে। ৪ঠা জুন গান্ধীজী একটি নির্দেশনায় সারাদেশে সত্যগ্রহ আন্দোলন বন্ধ করে দেন। ১৯ জুন এর বাড়তি আরও একটি ঘোষণা দেওয়া হয়। এই ঘোষণায় বলা হয়, কংগ্রেসী মন্ত্রীসভা সম্পর্কে কোথাও কিছু বলা যাবে না। ৯ জুলাই সুভাষ বসু 'জাতীয় সংগ্রাম সপ্তাহ' উদ্‌যাপন করেন এবং কংগ্রেসের এই অগণতান্ত্রিক কার্যক্রমের প্রতিবাদ করেন। এরপর কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে তাঁর বাদানুবাদ চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটি একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানালেন যে, 'গুরুতর নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য শ্রীযুক্ত সুভাষচন্দ্র বসুকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সমিতির সভাপতির পদের অযোগ্য বলিয়া ঘোষণা করা হইল এবং ১৯৩৯ সালের আগষ্ট মাস হইতে তিন বৎসরের জন্য তিনি কোনো নির্বাচিত কংগ্রেস কমিটির সদস্য হইতে পারিবেন না।'

 

এর ভিতরে ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩ মে তারিখে সুভাষ বসু  অল ইন্ডিয়া ফরওয়ার্ড ব্লক (All India Forword Block) নামক একটি দল গঠন করেন। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর জার্মান বাহিনীর পোল্যান্ড আক্রমণের [বিস্তারিত: জার্মান-পোল্যান্ড যুদ্ধ] মধ্য দিয়ে শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সুভাষ বসু এই সুযোগে তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করার উদ্যোগ নেন। পক্ষান্তরে যুদ্ধকালীন সময়ে ব্রিটিশদের পক্ষে থাকার পথ অবলম্বন করেন গান্ধীজী

 

১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে ২০-২২ জুন নাগপুরে ফরওয়ার্ড ব্লক প্রথম একটি সম্মেলন করে। এই সম্মেলনে একটি অস্থায়ী জাতীয় সরকারের আহ্বান করা হয়। এই সময় কলকাতায় হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের ঘোষণাও করা হয়। এই মনুমেন্ট অপসারণের দিন ধার্য করা হয়েছিল ৩রা জুলাই। ব্রিটিশ সরকার এর আগের দিন ২রা জুলাই সুভাষ বসুকে গ্রেফতার করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে প্রেরণ করে। ২৯ নভেম্বর তিনি মুক্তির দাবীতে জেলখানায় অনশন শুরু করেন। ৭দিন অনশন পালন করার পর তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে তিনি তখনও পুলিশি নজরে ছিলেন।

 

ইতিমধ্যে তিনি ব্রিটিশের শত্রু হিসেবে জার্মান, ইতালি, রাশিয়া ইত্যাদি দেশের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এই সব দেশের সহায়তায় সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ভারত স্বাধীন করা। এই সব রাষ্ট্রের সাথে পূর্বে কোনো যোগাযোগ না করেই, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, তিনি ভারত থেকে পালানোর উদ্যোগ নেন। এক্ষেত্রে তাঁকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল পাঞ্জাবের কীর্তি কিষাণ পার্টি এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের ফরওয়ার্ড ব্লকের সদস্যরা।

 

১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১ টা ২৫ মিনিটে পশ্চিমী মুসলমানী পোশাকে তিনি তাঁর এই গোপন যাত্রা শুরু করেন। এই যাত্রায় তিনি তাঁর শিশির বোসকে সাথে নিয়ে মোটর গাড়ি করে কলকাতা ত্যাগ করেন। ১৮ই জানুয়ারিতে কলকাতা থেকে প্রায় ২১০ মাইল দূরবর্তী গোমোতে পৌঁছান। শেষ রাতে ট্রেনযোগে তিনি উত্তর ভারতের দিকে রওনা দেন। এই সময় তিনি ছদ্ম নাম নেন মৌলবী জিয়াউদ্দিন। পেশোয়ার রেলস্টেশনে ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতা আকবর শা, সুভাষ বসুর সাথে মিলিত হন এবং এরপর উভয় পরবর্তী পেশোয়ার ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে নেমে পড়েন। তারপর টাঙ্গা গাড়ি করে নিয়ে স্থানীয় তাজমহল হোটেলে উঠেন। এরপর মুসলিম লীগের স্থানীয় নেতা আব্দুল মজিদ খাঁ তাঁকে গোপন আস্তানায় নিয়ে যান। এরপর সুভাষ বসুকে কাবুল পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া দায়িত্ব নেন ভগৎ সিং। ২১শে জানুয়ারি বিকাল চারটায় সুভাষ বসুর সাথে ভগৎসিং-এর দেখা হয়। পাঞ্জাবের কীর্তি কিষাণ পার্টি বাকি পথটুকু যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল।  আগে যে পথ ধরে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল, সে পরিকল্পনায় কিছু রদবদল করায় ভগৎসিং কিছুটা বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন। কারণ পরিবর্তিত পথের সাথে ভগৎসিং ততটা পরিচিত ছিলেন না। ২৫ মার্চ একজন পথ প্রদর্শক পাওয়ায়, সুভাষ বসু আবার যাত্রা শুরু করলেন। সাথে ছিলেন ভগৎ সিং, পথপ্রদর্শক, আবিদ খাঁ ও গাড়ির চালক। এঁরা এই যাত্রাপথে প্রথম থামেন খাজুরি ময়দান-এ। গাড়ির চালক  এবং আবিদ খাঁ এখান থেকে বিদায় নেওয়ার পর বাকি তিনজন পায়ে হেঁটে রওনা দেন। এঁরা রাত ১২টায় আশ্রয় নেন 'পিশকান ময়না' নামক গ্রামে। এখানে তাঁরা স্থানীয় একটি মসজিদে আশ্রয় নেন। এই সময় বাইরে  তুষারপাত চলছিল। এরপর সুভাষ বসু খচ্চরের পিঠে চড়ে এবং ভগৎ সিং, পথপ্রদর্শক ও খচ্চরওয়ালা পায়ে হেঁটে রওনা দেন। কিছুদূর যাওয়ার পর পথপ্রদর্শক বিদায় নিয়ে ফিরে যান। এরপর এঁরা গাওড়ি নামক একটি গ্রামে পৌঁছান পরের দিন বেলা ১২টার দিকে। এরপর খচ্চরওয়ালা বিদায় নিলে ভগৎসিং এবং সুভাষ বসু পেশোয়ার-কাবুল মহাসড়কে পৌঁছান। এই সড়ক ধরে এঁরা জালালাবাদের দিকে পায়ে হেঁটে রওনা দেন।  এঁরা এরপর পৌঁছান হারজানাও গ্রামে। এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন বাসোল গ্রামে। এখানে এসে চায়ের প্যাকিং বাক্স ভরা একটি ট্রাকে করে রাত দশটার দিকে এঁরা জালালাবাদ পৌঁছান। এখানে একটি সরাইখানায় রাত কাটিয়ে আড্ডাশরীফ মসজিদ দেখে 'লালমা' গ্রামে আসেন। এখানে ভগৎ সিং-এর পরিচিত একজন লোক ছিলেন। এই লোকটির নাম হাজি মোহম্মদ আমিন। এই লোকের পরামর্শ অনুসারে এঁরা কাবুল নদী পার হয়ে টাঙ্গায় করে সুলতানপুর যান। সেখানে ট্রাক না পেয়ে আরও সারাদিন পায়ে হেঁটে মিমলা গ্রামে আসেন। এখানে এসে তাঁরা একটি সরাইখানায় এসে কিছু আহার করেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া একটি ট্রাকে করে 'গনডামক' নামক স্থানে আসেন রাত নটায়। এখানে রাতের খাবার খেয়ে আবার ট্রাকে করে রওনা দেন। ভোরের দিকে এঁরা 'বুদখাক' চেকপোষ্টে পৌঁছান। ভোররাতে চেকপোষ্টের প্রহরীরা ঘুমিয়ে ছিল। তাই বিনা বাধায় চেকপোষ্ট পেরিয়ে এঁরা স্থানীয় একটি হোটেলে আশ্রয় নেন। এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে টাঙ্গায় চড়ে এঁরা কাবুলে পৌঁছান। এই দীর্ঘ ও দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এঁরা ৩১শে জানুয়ারি কাবুলে পৌঁছান।

 

 

Comments