শীতকে স্বাগত


আমাদের দেশে শীত খুব কম সময়ের জন্য আসে। শীতের পাখির মতো শীতকালও যেন এ দেশে এক বিশেষ অতিথি।

.
শীতের কুয়াশার প্রথম চিহ্ন দেখলে আলমারি থেকে গরম কাপড় বের করে স্বাগত জানানো হয় শীতকে। জীবনযাপনে  চলতে থাকে শীতের প্রস্তুতি।

সম্প্রতি নেপাল থেকে ঘুরে এলাম। ওখানে অনেক ঠান্ডা। সূর্যাস্তের পর আর বাইরে থাকা যায় না। ঠান্ডায় রক্ত জমে যায়। তবে ওখানকার অনুভূতি দেশে শীতের অনুভূতির মতো নয়। শীতের অনুভূতি বলতে আমরা যা বুঝি, তার সঙ্গে ঠান্ডার একটা সম্পর্ক থাকলেও ঠান্ডা আর শীত হয়তো এক নয়। আমার কাছে শীত একধরনের আবেগ। অথবা হয়তো অনেক ধরনের আবেগের সংমিশ্রণ। ঠান্ডা না পড়লেও শীতের আবেগ আমি অনুভব করি।

বাইরে তাকালে মনে হয় শীত চলে এসেছে। একধরনের লাজুক ধূসরতায় ছেয়ে গেছে চারদিক। এই ধূসরতা হৃদয়বিদারক এক অজানা আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেয়। যেন আমার সব স্মৃতি, সব খিদে খুব কাছে কোথাও লুকিয়ে আছে। নাগালের বাইরে, দৃষ্টির বাইরে। খুব কাছে থেকেও যেন যোজন যোজন দূরে।

হালকা শীতের বিকেল বা সন্ধ্যায় উষ্ণতাশীত আমাদের এখানে খুব কম সময়ের জন্য আসে। শীতের পাখির মতো শীতকালও যেন আমাদের এই দেশে এক বিশেষ অতিথি। অতিথি বেশি দিন থাকে না বলেই অতিথির জন্য সব ব্যবস্থা আমরা খুব আগ্রহ নিয়েই করি। বাইরে গরম থাকা সত্ত্বেও শীতের কুয়াশার প্রথম চিহ্ন দেখলে আলমারি থেকে গরম কাপড় বের করে ফেলি। সকালবেলা যদি মনে হয় তাপমাত্রা দু–এক ডিগ্রি কম, তাহলে গায়ে সোয়েটার, জ্যাকেট চাপাই। অক্টোবর মাস শেষ হতে হতেই আমরা শীতের চিহ্ন খুঁজি। শীত যেন দূরদেশ থেকে আসা খুব প্রিয় এক আত্মীয়। মনে হয়, কেন আসছে না। এলে মনে হয়, কেন তার এত জলদি চলে যেতে হবে।

প্রকৃতিও যেন শীতকে একজন বিশেষ অতিথি হিসেবেই দেখে। শীতকে স্বাগত জানাতে নিয়ে আসে খেজুরের রস, নতুন সবজি, আরও কত কিছু। শীতের আগমন উপলক্ষে প্রকৃতির উপহার আমরা দুহাত বাড়িয়ে বুকে তুলে নিই। নতুন ফুলকপি আর মটরশুঁটি দিয়ে রুই মাছ খেতে খেতে সাধারণ নৈশভোজকেও উৎসবের মতো মনে হয়। শীতের রাতে এক কাপ চা মনে হয় অনেক দিনের অপেক্ষার পর পাওয়া কোনো স্বর্গীয় পানীয়।

সব উৎসব এবং ভালো লাগার মধ্যেও কেন জানি শীতে আমার মধ্যে এক মারাত্মক আকুলতার উদয় হয়। আকুলতাটা বেশির ভাগ মানসিক। শীতের রাতে যখন ট্রেনের বাঁশি শুনি অথবা হিমেল হাওয়ায় সোডিয়াম বাতির হলুদ ভাসতে দেখি, মনের গহিনে থাকা অনেক স্মৃতি বেরিয়ে আসে। এমনভাবে বেরিয়ে আসে যে মনের মধ্যে এক পরম বেদনার জন্ম হয়। যেন শীতের মতোই প্রিয় স্মৃতিগুলো, স্মৃতির মানুষগুলো খুব কম সময়ের জন্য আমার কাছে এসেছে। অনেক দিনের হারিয়ে যাওয়া মানুষের কথা, মুহূর্তের কথা, জায়গার কথা যখন অকস্মাৎ মনে আসে, তখন ইচ্ছে করে শীতের রাতে গরম চাদরের মতো স্মৃতিগুলোকেও জাপটে ধরে রাখি। আর কখনো যেন হারিয়ে না যায়।

শীত এলেই অনেকে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে যায়। শীত এলেই বাবা আমাদের গ্রামে নিয়ে যায়। শীতের দিনে গ্রামে খেজুরের রস খাওয়া, খেতের মধ্যে দৌড়ে বেড়ানো আমার পুরোনো এবং মধুর স্মৃতি। শীত এলেই পিকনিকে গিয়ে বরইগাছে চড়ে বরই খেতে ভীষণ আনন্দ লাগে। শীতের কিছু বিশেষ গান আমার শুনতে বড়োই ভালো লাগে। 'শীতের হাওয়ায় লাগলো নাচন, আমলকির ওই ডালে ডালে' 

অতীতের আকুলতা আর আগামীর সব সৌন্দর্যের সোনালি সংমিশ্রণেই মধুর হোক আমাদের সবার শীতকাল।

 

313 Views

Comments