দিল্লি জামে মসজিদ


ভারতের সবচেয়ে অসাধারণ স্থাপত্যের মধ্যে অন্যতম দিল্লির জামে মসজিদ

.

দিল্লি জামে মসজিদ শুরুর দিকে ‘মসজিদে জাহান নামা’ বা ‘জগতের প্রতিবিম্ব মসজিদ’ নামে পরিচিত ছিল। বিংশ শতাব্দির শেষদিক পর্যন্ত এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় মসজিদ। মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তার ভ্রমণকাহিনীতে দিল্লি জামে মসজিদকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মসজিদ বলে উল্লেখ করেছেন। মোঘল সাম্রাজ্যের অপরূপ এই স্থাপনায় ব্যাপক হারে লাল পাথর, নুড়ি পাথর ও মর্মর পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। এই তিন পাথরের সমাহার মসজিদটির শোভা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারতের সবচেয়ে বড় জুমার নামাজ এই মসজিদে অনুষ্ঠিত হয় বলে এটির নাম দেয়া হয়েছে দিল্লি জামে মসজিদ। পঞ্চম মোঘল সম্রাট ও তাজমহলের স্থপতি শাহজাহানের নির্দেশে ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে এই মসজিদ নির্মিত হয়। ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ বা ১০৬৬ হিজরির ঈদুল ফিতরে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে এই মসজিদ উদ্বোধন করা হয়। দিল্লির পুরনো অংশে এই মসজিদ নির্মাণের জন্য ৫,০০০ শ্রমিক ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন। এটিতে একসঙ্গে ২৫ হাজার মুসল্লি জামায়াতে নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদটি শুরুতে আকারে ছোট থাকলেও এর জন্য সম্রাট শাহজাহান যে বিশাল জমি বরাদ্দ দিয়েছিলেন পরবর্তীতে তার প্রায় পুরোটা জুড়ে মসজিদটি বিস্তৃত হয়েছে।

তিনটি বিশাল ফটক সম্বলিত মসজিদটিতে চারটি সাদা গম্বুজ এবং দুটি মিনার রয়েছে।  মিনার দুটির উচ্চতা প্রায় ৪০ মিটার। মিনার দুটির পাঁচটি ধাপে পাঁচটি করে ব্যালকনি রয়েছে, যার প্রথম তিনটি লাল বেলেপাথর, চতুর্থটি সাদা মার্বেল এবং পঞ্চমটি সাধারণ পাথর দিয়ে তৈরি। লাল বেলেপাথর এবং সাদা মার্বেলের স্ট্রাইপ দেয়া মিনার দুটি সূর্যের আলোর তীব্রতা ভেদে রং বদলায়। ঝলমলে সূর্যালোক এবং ভরা পূর্ণিমার সময়ে এর নয়নাভিরাম সৌন্দর্য যেকোনো মানুষের হৃদয় কাড়ে। দিল্লি জামে মসজিদের দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০০ মিটার এবং প্রস্থ ২৭ মিটার।

মসজিদের মেঝে তৈরি হয়েছে সাদা ও কালো মরমর পাথরের মিশ্রনে। প্রতিটি মুসল্লির সিজদার স্থান এই মর্মর পাথর বসিয়ে চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে। এই নামাজের স্থানগুলির প্রতিটির দৈর্ঘ্য ৯১.৪৪ সেন্টিমিটার এবং প্রস্থ ৫০ সেন্টিমিটার। মসজিদের মূল চত্বরে এরকম ৮৯৯টি নামাজের স্থান চিহ্নিত করা আছে।

উপমহাদেশের আরো অনেক মসজিদের মতো দিল্লি জামে মসজিদেও ফার্সি শিলালিপি রয়েছে। ভারতে মোঘল শাসনের সময় ইরানে চলছিল সাফাভি রাজবংশের শাসন। এ কারণে এসব শিলালিপিতে তৎকালীন সাফাভি শাসনামলের লেখ্যরীতি চোখে পড়ে। মোঘল সম্রাট শাহজাহান দিল্লি জামে মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব পালনের জন্য উজবেকিস্তানের বুখারা এলাকা থেকে একজন আলেমকে আমন্ত্রণ জানিয়ে দিল্লিতে নিয়ে আসেন। ওই আলেমের নাম ছিল সৈয়দ আব্দুল গফুর শাহ বুখারি। দিল্লির জামে মসজিদের ইমাম নিয়োগ দিয়ে তাকে রাষ্ট্রীয় ইমাম হিসেবে ঘোষণা দেন সম্রাট শাহজাহান।  এ সময় সৈয়দ বুখারির পদবি দেওয়া হয় ‘শাহি ইমাম’। মুঘল আমলে সম্রাট হওয়ার ব্যাপারে বংশ পরম্পরাকে আদর্শ মনে করা হতো। জামে মসজিদের ইমাম হওয়ার শর্ত হিসেবেও বংশের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল আমলের পর নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটলেও জামে মসজিদের ইমামদের ক্ষেত্রে বংশ পরম্পরায় ইমাম হওয়ার প্রথা এখনো চালু আছে। বর্তমানে শাহি ইমাম হিসেবে সৈয়দ আবদুল গফুর শাহ বুখারির ১৩তম উত্তরসূরি সৈয়দ আহমেদ বুখারি নিয়োজিত।

 

Comments